টঙ্গী: এই প্রথম ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমায় শামিয়ানা সংকট দেখা দিয়েছে। আর পরিস্থিতি উত্তরণে সকল জেলা থেকে শামিয়ানা চাওয়া হয়েছে। শামিয়ানা সংকটের কারণে খিত্তা কমিয়ে ১০৫ থেকে ৯৭টিও করা হয়েছে। এই কৃত্তিম সংকট তৈরীর পিছনে জুবায়ের ও সাদ গ্রুপের দ্বন্ধ দায়ী বলে মনে করছেন ইজতেমা সংশ্লিষ্টরা।
রবিবার( ২৮ জানুয়ারী) টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান ও উত্তরার দিয়া বাড়ি ময়দান ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
রবিবার(২৮ জানুয়ারী) সকাল নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার সাদ ও জুবায়ের পন্থী নেতাদের সাথে নিয়ে ইজতেমা মাঠ পরিদর্শন করেন। এসময় বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে দেখার সময় দুই গ্রুপের নেতারা পরস্পর বিরোধী এই সকল অভিযোগ করেন।
পরস্পর বিরোধী বক্তব্য থেকে জানা যায়, গত বছর বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার পর জুবায়ের পন্থীরা অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ভাংচুর করে ও কিছু নিয়ে যায় বলে সাদ পন্থীদের অভিযোগ। আর জুবায়ের পন্থীদের অভিযোগ, গত বছর সাদ পন্থীরা দ্বিতীয় পর্ব শেষ করে অনেক মূল্যবান জিনিস নিয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট বেশ কিছু জিনিস ভাংচুর করে গেছেন। এই অবস্থায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার উভয় পক্ষকে নিয়ে সভা করে দুই পক্ষকে একমত করেছেন বলে প্রেসব্রিফিং করে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হওয়ার সাথে সাথে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টর দিয়া বাড়িতে রাজউকের ৬০ একর খালি জায়গায় প্যান্ডেল নির্মান শুরু হয়। বলা হয়েছিল, বিশ্ব ইজতেমার দুটি ময়দানে মুসল্লীরা থাকবেন। তবে টঙ্গীর ময়দান থেকে বয়ান ও আখেরী মোনাজাত প্রযুক্তির মাধ্যমে দিয়া বাড়ি মাঠে প্রচার করা হবে। ইজতেমায় মোট ১০৫ টি খিত্তা হবে। এরমধ্যে টঙ্গীর ময়দানে ৭২টি, তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে ১০ টি ও দিয়া বাড়িতে ২৩ টি খিত্তা হবে। ৬৪ জেলার মধ্যে ২৩ জেলার মুসল্লীরা দিয়া বাড়িতে থাকবেন। একই সাথে বিদেশি মেহমানদের জন্যও দিয়া বাড়ি প্রস্তুত। দিয়া বাড়ি ময়দানের জিম্মাদার মাওলানা ফরিদ আহমদ ২১ জানুয়ারী কে বলেছিলেন, এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রধান সমন্বয়কারী জুবায়ের পন্থী নেতা প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান এ বিষয়ে সব জানেন। মাহফুজ হান্নান দায় স্বীকার করে বলেছিলেন, টঙ্গী মাঠে লোক সমাবেশ বেশী হওয়ায় দিয়া বাড়িতে ময়দান প্রস্তুত করা হয়েছে। পরবর্তী সময় ২৩ জানুয়ারী টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার আইন শৃঙ্খলা কমিটির ফলো আপ সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুলিশের আই জিপির নির্দেশে দিয়া বাড়ি ময়দানের প্রস্তুতি কাজ বন্ধ করা হয়। ফলে সহজেই প্রশ্ন উঠে যায়, জুবায়ের পন্থীরা সরকারের অনুমতি না নিয়ে কেন দিয়া বাড়ি মাঠে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন! আর বিনা অনুমতিতে টঙ্গী ময়দান থেকে শামিয়ানা সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়া বাড়ি ময়দানে গেলো কি করে? জুবায়ের পন্থীদের এই কাজ কি উদ্দেশ্যে এবং কেন করা হয়েছিল তা তদন্তের দাবী করেছেন সাধারণ মুসল্লীরা।
সরেজমিন দিয়া বাড়ি ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল ময়দানের শামিয়ানা খোলা হচ্ছে। সাথে পুলিশি প্রহরা রয়েছে। শামিয়ানা খোলার কাজে নিয়োজিত মুসুল্লি হাফিজুর রহমান জানান, টঙ্গীর ময়দান থেকে এসব আনা হয়েছিল। এখন সেখানে ফেরত দেয়া হচ্ছে। দিয়া বাড়ি মাঠে ইজতেমা হবে না, তাই মালামাল ফেরত যাচ্ছে।
এদিকে শামিয়ানা সংকট সমাধানে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ সকল জেলা থেকে শামিয়ানা এনে টাঙানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ইজতেমা ময়দানের শামিয়া,না দিয়া বাড়ি ময়দানে নেয়ার কারণে এই সংকট বলে মনে করছেন ইজতেমা মাঠে কাজে নিয়োজিত মুসুল্লিরা। আবুল হাসেম নামে একজন মুসল্লী কালের কন্ঠকে বলেন, দিয়া বাড়িতে শামিয়ানা না নিলে এখন শামিয়ানার অভাব হতো না। যে পরিমান শামিয়ানা নেয়া হয়েছিল সে পরিমান মালামাল ফেরত আসার সম্ভাবনাও কম। আর এই অল্প সময়ে সকল জেলার মুসল্লীরা কিভাবে শামিয়ানা টাঙাবে তাও অজানা।
ইজতেমা ময়দানে কর্মরত অনেক মুসল্লীরা বলেন, দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণে এই কৃত্রিম সংকট তৈরী হয়েছে। আর এর জন্য সমস্যায় পড়েছেন সারা জেলার মুসল্লীরা।
ইজতেমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই গ্রুপ পরস্পরকে ঘায়েল করতে এই সব কর্মকান্ড করছে। সঠিক মনিটরিং এর অভাবকে দায়ী করছেন তারা।
এসকল বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, শামিয়ানা সংকট নেই। ফাঁকা জায়গা পূরণ করা হবে বলে তিনি বলেন, ইজতেমার প্রস্তুতি কাজ শেষের পথে। বিবদমান দুই পক্ষ সমঝেতায় এসেছে। কোন সমস্যা নেই।
জিএমপির কমিশনারের প্রেসব্রিফিং
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। এখন কোন সমস্যা নেই। এবার ছয় হাজার পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। কোন ক্রমেই হকার বসতে দেয়া হবে না বলে প্রেসব্রিফিং করে জানিয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম।
বিবার বেলা ১টায় টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে ইজতেমার দুই গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা সভা শেষে সাংবাদিকদের পুলিশ কমিশনার এসব কথা বলেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, জুবায়ের পন্থীদের প্রতিনিধি প্রকৌশল মেজবাহ উদ্দিন, সাদ পন্থীদের আমির রেজাউল করিম সাদ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সহ বিশ্ব ইজতেমা সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের প্রতিনিধিগণ।
পুলিশ কমিশনার বলেন, এবারের দুই পর্বেই ছয় হাজার করে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পুলিশ ছাড়াও আনসার র্যাব সহ অন্যান্য বাহিনী প্রতি বছরের মত নিয়োজিত থাকবে।
বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা প্রসঙ্গে পুলিশ কমিশনার বলেন, দুই পর্বের দায়িত্ব পালন নিয়ে কথা হয়েছে। কিছু অমিমাংসিত বিষয় মিমাংসা হয়েছে। দুই পক্ষই একমত হয়েছেন। বিশ্ব ইজতেমার কতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রস্তুতি প্রায় শেষ। খালি জায়গা গুলো পূরণ করা হবে।
সভা শেষে জুবায়ের পন্থীদের প্রতিনিধি প্রকৌশলী মেজবাহ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা দুই গ্রুপ বসেছিলাম। সব বিষয়ে ফয়সালা হয়েছে। এখন কোন ঝামেলা নেই।
একই গ্রুপের সূূরা সদস্য আহাম্মদ আলী বলেন, ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ফাঁকা জায়গায় শামীয়ানা বিভিন্ন জেলা থেকে আসবে। শামিয়ানার সংকট কি না এ বিষয়ে তিনি বলেন, কোন সংকট নেই। ইজতেমার জায়গা বেড়েছে তাই চাহিদাও বেড়েছে। দিয়া বাড়িতে থাকা শামিয়ানা আসবে বলে জানান তিনি।
সাদ গ্রুপের প্রতিনিধি দলের প্রধান রেজাউল করিম বলেন, সমঝোতা হয়েছে। দেখা যাক কি হয়।
একই গ্রুপের সূরা সদস্য মাওলানা মিজানুর রহমান বলেন, কিছু দামী জিনিসপত্র ওরা নিয়ে গিয়েছিল গত বছর। সেগুলোর বিষয়ে কথা হয়েছে।
এদিকে বিশ্ব ইজতেমার মূল ময়দানের অনেক অংশ এখনো ফাঁকা রয়েছে। শেষ হয়নি মূলমঞ্চের কাজ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দিয়া বাড়িতে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ময়দান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা বন্ধ হওয়ার পর ওই মাঠ থেকে শামিয়ানা সহ অন্যান্য সরঞ্জাম এখনো টঙ্গী ময়দানে আসেনি। ফলে আয়োজনে সংকট চলছে।
প্রসঙ্গত: টঙ্গীর তুরাগ তীরে ৫৭ তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হবে দুই থেকে চার ফেব্রুয়ারী। দ্বিতীয় পর্ব নয় থেকে এগার ফেব্রুয়ারী। ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা।