চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভিসি ড. শিরীণ আখতার সম্প্রতি নতুন নিয়োগ পাওয়া দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যাখ্যা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দেয়া বিজ্ঞাপনটিতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও।
প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে দেখা গেছে সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানকেও। নানা প্রতিষ্ঠানের এমন বিজ্ঞাপন দেয়া এবং এর জন্য ব্যয় করা অর্থের উৎস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে নানা আলোচনা।
কী রয়েছে বিজ্ঞাপনে?
ভিসি ড. শিরীণ আখতার যে বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো ও ভিসি হিসেবে নিজের নাম ব্যবহার করেছেন।
বিজ্ঞাপনটিতে ‘বীর চট্টলার দুই কৃতী সন্তানকে মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করায় বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা’ জানানো হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনাদের সুযোগ্য নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ রূপকল্প বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে’।
যদিও ১১ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পরদিনই নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নির্দেশ দিয়েছিলেন, কেউ যেন এ ধরনের অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা না জানায়। ওইদিনই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সেবা শাখা এ সংক্রান্ত একটি নোটিশ জারি করে।
ওই নোটিশে বলা হয়েছিলে, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সফল শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে শিক্ষা পরিবারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে বিধায় শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় সভায় নতুন করে ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা না জানানোর জন্য মন্ত্রী নির্দেশনা প্রদান করেছেন।’
যা রয়েছে ইউজিসির নোটিশে
বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে।
এক নোটিশে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জানতে চেয়েছে, কয়টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে ও কোন খাত থেকে এর ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ কেন অনুসরণ করা হয়নি তাও আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জানাতে হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে।
ইউজিসির দেয়া নোটিশে সাতটি সংবাদপত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
নোটিশে দ্যা ডেইলি স্টার, দ্যা ডেইলি সান, দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দ্যা ডেইলি অবজারভার, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক সমকালসহ একাধিক সংবাদপত্রে চার কালার বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কোন খাত থেকে বিজ্ঞাপনের অর্থ ব্যয়?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ও চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কোনো খাতে অর্থ বরাদ্দ দেয় না ইউজিসি। এছাড়া নতুন শিক্ষামন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পরই এ ধরনের কোনো কাজ যাতে কেউ না করে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই ইউজিসি তার কাছে জানতে চেয়েছে কোন আর্থিক ক্যাপাসিটিতে তিনি তা করেছেন?’
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করে কাউকে ধন্যবাদ দেয় এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যখন ইউজিসির আওতাধীন কোনো পাবলিক এনটিটি এটা করে তখন জানার এখতিয়ার রয়েছে তারা পাবলিক মানি ব্যবহার করে এটা করেছেন কিনা?’
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’দফায় আট বছর ভিসি ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর।
তিনি জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের ব্যয় নির্বাহের নিজস্ব কোনো খাত থাকে না। আর সরকারের বরাদ্দের বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আয় তা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ফি থেকে আসে। এটা একেবারেই নির্ধারিত করা থাকে কোন কোন খাতে ব্যয় করা হবে। এ অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করার অধিকার কারো থাকে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবারই প্রথম এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। অতীতে কখনো কোনো ভিসির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসেনি।
চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আলমগীর জানান, ‘ভিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়ার পর আসলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইউজিসির নিজস্ব ফ্রেমওয়ার্ক আছে, বিধি-বিধান আছে। সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত হবে। তবে, যেটা আমাদের আয়ত্ত্বের বাইরে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবো।’
তবে এ ধরনের ঘটনায় কেউ দায়ী প্রমাণিত হলে সুনির্দিষ্ট কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে কি-না তা তিনি বলতে পারেননি।
যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
সকাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে বার বার ফোন করলেও রিসিভ করেননি তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ বলেন, ‘আমরা জবাব দেবো। এখনো বিজ্ঞাপনের বিল দেয়নি। বিল পেলে কোন খাত থেকে দেয়া হবে সেটা দেখব। ভাইস চ্যান্সেলরের পারসোনাল ফান্ড থেকেও বিল দিতে পারেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে শুভেচ্ছা জানাতে বাধা নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে যদি টাকা ব্যবহার করেন সেটা হবে অনৈতিক। শুভেচ্ছা জানানোর চেয়ে বড় কথা তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটা করেছেন।’
পিছিয়ে নেই সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানও
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় কোনো বড় পদে কারো নিয়োগ হলে বা গুরুত্বপূর্ণ পদে গেলে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সাথে ছবি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়।
ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের শুভেচ্ছা জানানোর ঘটনা অহরহ দেখা যায়। কিন্তু কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিনন্দন জানানোর ঘটনা এবারই প্রথম।
এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে সিটি করপোরেশনের মেয়রদেরও এবারের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে দেখা যায়।
বৃহস্পতিবার ইংরেজি সংবাদপত্র নিউ এইজ পত্রিকায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুন এ ধরনের একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।
এতে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বিজয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সফিউল আজমকে ফোন করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। মেয়র জায়েদা খাতুনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমও ফোন ধরেননি।
শুধু গাজীপুরেই নয় ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পক্ষেও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন জানান, ‘সব সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বিজ্ঞাপন ফান্ড থাকে। সেখান থেকেই এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ব্যয় বহন করা হয়। সিটি করপোরেশনের সরকারের অংশ। তাই সরকার প্রধানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে কোনো সমস্যা নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মজুমদার বলেন, ‘এসব নমুনা শুধু তোষণই নয়, দলীয়করণের নগ্ন উদাহরণ। এগুলোর কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়, একটা সঙ্কটের দিকে যাওয়ার উদাহরণ এগুলো।’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, তাদের ফান্ড থাকলেও এটা কার কল্যাণ বয়ে আনবে?’
তিনি আরো বলেন, ‘যারা করছে তাদের কল্যাণ ছাড়া, অর্থ অপচয় ছাড়া আর কারো কল্যাণ বয়ে আনবে না এসব।’
সূত্র : বিবিসি