আসাদুজ্জামান আকাশ : ১৫ জানুয়ার সোমবার অনুষ্ঠিত হলো গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের বিনিরাইল গ্রামের জামাই মেলা।
মেলা হল একটি সামাজিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য কারণে একটি স্থানে অনেক মানুষের মিলন স্থল। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি জাগে। মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়, হয় দীর্ঘ বিরতির পরে নতুন করে দেখা। বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম এই মেলা, যা অন্যভাবে মিলনের স্থল নামে পরিচিত। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড়। বাংলার এই মেলা সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মের মানুষের সংস্কৃতি ও সহ অবস্থানের সমন্বয়। অর্থাৎ মেলা হল বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাম্যের প্রতীক। সাধারণত কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোন খোলা মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে । মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে আসে এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য।
মেলায় দর্শকদের তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের জন্য থাকে নানান আয়োজন। নাগরদোলা, লাঠি খেলা, কুস্তিখেলা, পুতুল নাচ, যাত্রাগান, কবিগান, বাউল গান, ঘেটু গান, জারি গান, গাজীর গান, পীর-ফকিরদের গান, বায়োস্কোপ, সং, সার্কাস, লটারি, কীর্ত্তন, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি আয়োজন দর্শকদের বাড়তি আনন্দের খোরাক যোগায়। সাথে থাকে পিঠা পুলি সহ লোকজ খাবারের বিশাল সমাহার। বিশেষ করে জিলাপি, গজা, রসগোল্লা, বালিশ মিষ্টি, কদমা, বাতাসা, বিন্নি ধানের খৈ ও দই-চিড়ার স্বাদই যেন আলাদা। এছাড়াও কাপড়, মনিহারি, প্লাস্টিক পণ্য, পূজার জিনিসপত্র, ধর্মীয় পোস্টার, ছবি, বাঁশ-বেতের সামগ্রী, তামা-কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র প্রভৃতির দোকানও বসে মেলায়।
বর্তমানে মেলা অনেক ধরণের হয়ে থাকে। তার মধ্যে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের বিনিরাইল গ্রামের জামাই মেলা বেস প্রসিদ্ধ ও আকর্ষণীয় মেলা হিসাবে পরিচিত। জামাই মেলা বা জামাই মৎস মেলা বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল গ্রামের বার্ষিক গ্রাম্য মেলা। মেলাটি প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে অর্থাৎ বাংলা পৌষ মাসের শেষে মাঘ মাসের প্রথম দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলমান থাকে এই মেলা। মূলত এটা শীতকালীন মেলা ও জামাই মেলা। মাছের মেলা নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সারাদিন ব্যাপী চলে নানা রকম আনন্দ-উৎসব। দিনটির জন্য সারাটি বছর অপেক্ষায় থাকেন এই গ্রামের লোকজন সহ আশেপাশের গ্রামের এবং দূরের মানুষেরা। এই মেলায় আছে একের ভেতর দুই। এক কথায় রথ দেখা আর কলা বেচা। কারণ এটা জামাই মেলা হলেও, এখানে বসে মাছের বিরাট মেলা। বিনিরাইল এবং এর আশপাশের গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন, সেসব জামাইয়েরা হচ্ছে ওই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শণার্থী। তাছাড়া এই মেলাকে ঘিরে এলাকার জামাইদের মধ্যে চলে এক নীরব প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটি হচ্ছে কোন জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি ক্রয় করে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। ফলে বাজারের সবচেয়ে বড় মাছকে ঘিরে ক্রেতা জামাইদের থাকে জটলা। মাছের নাম পাখি মাছ। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ১ লক্ষ বিশ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে অনেকে অনেক দামাদামি করছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরও বেশি দাম পাওয়ার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দর কষাকষি। যত না ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমায় জামাইদের এই নিরব মাছ কেনার লড়াই দেখার জন্য। মাছের কেনার এই দরকষাকষি হয়ে ওঠে এই মেলার মূল আকর্ষণীয় বিষয়। গাজীপুরের ‘মা মৎস আরতের মালিক জানান, প্রতি বছরই এই মেলায় তার দোকান থাকে এবং সর্বোচ্চ বিক্রি উনিই করার চেষ্টা করেন।
প্রতি বছর মেলা উপলক্ষে এই অঞ্চলের কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ তাদের মেয়ের জামাতাদেরকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানায়। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে মেলা উপলক্ষে তাদের পিতা-মাতার বাড়িতে আসেন এবং জামাতাগণ মেলা থেকে মৎস ক্রয় করে থাকেন, যার ফলে উভয় অঞ্চলেই মেলা দুটি জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়।
কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরণ পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। মেলা মানেই মহামিলন। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দেয়। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের এক মহা সম্মিলন।