জাতীয় পার্টি সংসদে যাবে কিনা সেটা দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের)।
সোমবার (৮ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে রংপুর মহানগরীর পল্লী নিবাসের লিচুতলায় জাতীয় পার্টির (জাপা) মরহুম চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কবর জিয়ারত শেষে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে একথা বলেন তিনি।
এর আগে পৈত্রিক নিবাস সেনপাড়ার স্কাইভিউ থেকে নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে এরশাদের কবর জিয়ারত ও মোনাজাত করেন জি এম কাদের। এসময় কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক শাফিউল ইসলাম শাফী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য লোকমান হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, হাসানুজ্জামান নাজিমসহ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কাউন্টিং নয়, সরকারের ইচ্ছা কাউন্টিং হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জি এম কাদের। এর উদাহরণ হিসেবে ঢাকা-১সহ ২০টি আসনের ভোট বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ভোটার কম থাকলেও প্রিজাইডিং, রিটার্নিং ও পুলিশের উপস্থিতিতে ভোট মেরে ভোট কাস্টিং বেশি দেখানো হয়েছে। ফলে এই নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এসময় দলীয় সরকারের অধীনে ভোট সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার পুনরাবৃত্তির কথা জানান জি এম কাদের।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যেটা আমার চোখে পড়েছে, যেটা আমার পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হলো, তাতে প্রতীয়মাণ এটা সম্পূর্ণ সরকারনিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হয়েছে। যেটা আমরা সব সময় ভয় করছিলাম। যেখানে সরকার মনে করেছে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার দরকার সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। যেমন রংপুর-৩-এ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। এখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে নাই। আবার অনেক স্থানে যেখানে সরকার মনে করেছে কোনো একটা ডেফিনিট প্রার্থীকে উনি পাস করিয়ে নিবেন, সেটা তিন নম্বরে থাকুক বা চার নম্বরে থাকুক, আর যাই হোক তাকে পাস করিয়ে আনা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পীরগঞ্জের যে প্রার্থী তিনি প্রিজাইডিং অফিসারকে আগে থেকেই সাইন করা রেজাল্ট শিট তৈরি করা কাগজপত্রসহ ধরেছিল। পীরগাছা, কাউনিয়ায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, এখানে ভোটটা কাউন্ট করা হচ্ছে না। সরকারের ইচ্ছাটাকে কাউন্ট করা হচ্ছে। সেভাবেই রেজাল্ট তৈরি করা হচ্ছে।’
‘আর যেহেতু টার্নআউট যথেষ্ট কম ছিল, স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম সংখ্যায় ভোটার ভোটকেন্দ্রে এসেছিলেন, সেখানে বাকি যে ব্যালট পেপারগুলো ছিল সেগেুলো আমাদের এজেন্টকে বের করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে নৌকা ও স্বতন্ত্রের কর্মীরা ভেতরে ঢুকে প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ও পুলিশের সামনে তাদের সহযোগিতায় সিল মেরেছে। এভাবে করার অর্থই হলো সরকারের পাতানো ছকে ইচ্ছায় ভোট হওয়া,’ বলেন জি এম কাদের।
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘সরকারের নিরপেক্ষ প্রশাসন, পেশীশক্তিহীন ও অর্থের প্রভাবমুক্ত থাকার যে ওয়াদায় আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম, সে ওয়াদা রক্ষা করেনি সরকার। তাদের ওয়াদার কারণে আমরা সরাসরি প্রার্থী দিয়েছিলাম আওয়ামী লীগের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য। তারা কথা দিয়েছিল অনিময় হবে না। কিন্তু তারা পাতানো ছকেই নির্বাচন করলো। যেমন ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) তার মধ্যে একটা। সেখানে আমাদের শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন সালমা ইসলাম। উনি সেখানে যথেষ্ট পপুলার। যথেষ্ট ভোট সেখানে ছিল। আমি নিজেই সেখানে গিয়েছিলাম।’
‘উনি (সালমা ইসলাম) খুব আশাবাদী ছিলেন যে স্বাভাবিক ভোট হলে উনি জিততে পারবেন। সরকারের তরফ থেকে ওনাকে সেরকম আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল যে ওখানে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনোরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম আগের দিন রাত থেকে সেখানে বিভিন্নভাবে তার নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, এজেন্টদের কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়াসহ তাণ্ডব তৈরি করে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো। যাতে ভোট দিতে মানুষ না আসে। এবং নেতাকর্মীদের বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা হলো। অপবাদ দিয়ে তাকে এলাকাছাড়া করার উপক্রম করা হয়েছিল। তারপরেও উনি টিকে ছিলেন লাস্ট পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানকার প্রত্যেকটি কেন্দ্র দখল করে সিল মেরে জোর করে ভোট করিয়ে নেয়া হয়েছে। অনিয়ম করে জোর করে সামলা ইসলামকে হারানো হয়েছে।’
জি এম কাদের বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বারংবার আমাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে এসব করা হবে না। যা ভোট হবে সেটিই কাউন্ট করা হবে। এবং তাতে যে প্রার্থী জিতবে সে-ই হবে এমপি। কিন্তু সরকার কথা রাখেনি। ২০/২২টি আসনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ভোটের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এসব আসনে আমাদের লোকজনকে বের করে দেয়া হয়েছে, মেরেছে। প্রার্থীকে ধরে মারা হয়েছে। প্রার্থীকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। বারংবার বলার পরেও পুলিশ আসেনি। যাদের প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব ছিল সেটাও তারা করেনি। প্রিজাইডিং-পোলিং অফিসারদের সামনে বসে, পুলিশের সামনে বসে সবাই মিলে তারা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে এর আগে বারবার আমরা কমপ্লেইন করতাম। সব সময় বলতাম এভাবে নির্বাচন করলে কখনোই সুষ্ঠু হবে না। সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে এরকম হচ্ছে। এটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কিন্তু সেটারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে কাল।’
এই অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপার হলো- জনগণ গ্রহণযোগ্য মনে করবে কি করবে না সেটা জনগণের ব্যাপার। তবে আমি যেটা বুঝি, টার্নআউট দেখেই বোঝা যায় যে জনগণ তেমন একটা ভোট দিতে আসেনি। এতে এই ভোটের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পাবলিক যাই আসে আসুক, ব্যালটে অনেক সিল মেরে এবং ফলাফলের সময় কারচুপি করে ভোটের কাউন্টিং বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু পাবলিকের উপস্থিতি অনেক কম ছিল। তাই আমার কাছে এই ভোটটা সহজভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ ভোটারদের উপস্থিতি কম। সরকারের নির্ধারিত ভাবে ভোট সুষ্ঠু করা, অসুষ্ঠু করা, কাউকে বের করে আনা- এগুলো মোটামুটি আমরা অ্যাপারেন্টলি দেখতেই পাচ্ছি। এবং আমাদের কাছে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ আছে। আমার প্রার্থীদের সাক্ষ্য-প্রমাণসহ নিয়ে আসতে বলেছি। সেগুলো নিয়ে আসবে।’
জি এম কাদের বলেন, ‘সংসদে যাব কি যাব না, সেটা দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।’
নির্বাচনে ভরাডুবির ঘটনা জাতীয় পার্টি ধংস হয়ে যাওয়ার প্রচারণাকে মিডিয়া এবং সরকারি প্রপাগান্ডা বলে দাবি করেছেন জি এম কাদের। দল ধ্বংসের চেষ্টার জন্য সরকারকে দায়ী করেন তিনি।
সরকার জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে এবং প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে জি এম কাদের বলেন, ‘যে নির্বাচন সরকারের পাতানো, সেই নির্বাচনের ফলাফলে দিয়ে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার বিষয়টি মিডিয়ার পাশাপাশি সরকার এবং যারা ভোটে যায়নি তাদের প্রপাগান্ডা। এধরনের প্রপাগান্ডা শুধু এখন নয়, এরশাদ সাহেব যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনো হয়েছে। যখন ক্ষমতায় ছিলেন না, তখনো হয়েছে। তারপরেও হয়েছে। সব সময় একটি আলোড়ন উঠেছে যে এবারই জাতীয় পার্টি শেষ, এটা একটা রিজিওনাল পার্টি। অন্য কোথাও কোনো ভোট নেই। তাহলে এবার পাতানো নির্বাচনেও কেন সারাদেশ থেকে নির্বাচিত হলো। কাজেই এসব প্রপাগান্ডা। জাতীয় পার্টি আছে, থাকবে। আমাদের ভোট ব্যাংকও আছে। এ ধরনের প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়াবে।’
জাতীয় পার্টির মধ্যকার কোন্দল সরকারের সৃষ্টি দাবি করে জি এম কাদের বলেন, ‘আমাদের ভেতরে যে কোন্দলের কথা বলা হয়, সেটা সরকার তৈরি করেছে। সরকারই আমাদের মাঝে বিভিন্নভাবে নিজস্ব লোকজন ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের কাজকর্মের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করছে। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে, যাতে আমরা একমত হতে না পারি। তার একটা পরিবেশ ক্রিয়েট করে সরকার। আমাদের দল যদি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারতো তাহলে এ ধরনের সমস্য হতো না। সরকারের মদদে আমাদের দল নিয়ে এই অবস্থাগুলো হচ্ছে।’
নেতাকর্মীদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই, সুদিন সামনে- দাবি করে জি এম কাদের বলেন, ‘নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আমি বলবো, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের সামনে আরো অনেক দিন আছে। আমরা মাঠে আাছি। জনগণ আমাদের সাথে আছে। যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা হচ্ছে ইনটেনশনালী – সরকারের মদদে, যারা আমাদের পছন্দ করে না তাদের মদদে – এসব কেটে যাবে। সত্য সত্যই। সেটা একদিন বেরিয়ে আসবে। আমরা দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করেছি। এখনো করছি। এবং আমরা যেটা করছি সেটা জনগণের বিপক্ষে নয়। কারো অপকর্মকে সমর্থনের জন্য নয়। কারো কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নয়। আমাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই আমরা কাজ করছি। সেই রাজনীতি জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্যই আমরা সবকিছু করছি।’
এর আগে স্কাইভিউয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন জি এম কাদের।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগের তিনটিসহ সারাদেশে ১১টি আসন পেলেও জাপা নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই।