৭ জানুয়ারির নির্বাচনেরর পর অনেকগুলো বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে নতুন সরকারের সামনে। প্রথমেই খুঁজতে হবে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। এর সাথে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি।
এছাড়া দ্রব্যমূল্য, ডলার সঙ্কট, রিজার্ভ সঙ্কট, বেকারত্ব ও বিরোধী দলের আন্দোলন ইত্যাদি তো থাকবেই।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যদি বলতে হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক এখন ভালো যাচ্ছে না। এটা আমরা সবাই জানি। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে কারা ক্ষমতায় আসবে সেটাও আমরা জানি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যিনি আছেন তিনিই থাকছেন। তার দলই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। ফলে নতুন সরকারকে পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করাটাকে আমি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলব। কারণ, আমাদের রফতানির প্রধান বাজার কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা। ফলে অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে তাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে সেই সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যে পুরোপুরি ইতিবাচক নয়, তা তাদের বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছুদিন ধরেই চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধা দিতে চাওয়া ব্যক্তিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আনার ঘোষণাও দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গন নয়, দেশের মধ্যেও মানুষ তাদের কতটা গ্রহণ করছে, সেটাও বড় বিষয়। সরকারের মন্ত্রীদের কথা শুনলে মনে হয় তারা লেখাপড়া করেননি। যে ভাষায় তারা কথা বলেন, একজন শিক্ষিত, সচেতন রাজনীতিবিদের পক্ষে ওই ভাষা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের এসব বিষয়ে কিছু যে বলেন তা-ও মনে হয় না। দেশের মানুষের সঙ্কট নিয়ে তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে যে বক্তব্য দেন সেটা মানুষকে কতটা কষ্ট দেয় তারা সেটা বোঝার চেষ্টাও করেন না। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের নিজেদেরও গ্রহণযোগ্য হতে হবে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘নতুন বছরে অর্থনৈতিক সেক্টরে যে চ্যালেঞ্জ তার কোনোটাই নতুন নয়। সবগুলোই বিদায়ী বছরে ছিল। মূল্যস্ফীতি আগেও ছিল, এবারও থাকবে বলে ধারণা করা যায়। ডলার সঙ্কট ও ডলারের মূল্য নির্ধানের সঙ্কটটিও নতুন নয়। দ্রব্যমূল্যও নতুন নয়। ফলে অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জগুলো আগে ছিল, সেগুলো এবারো থাকবে। নতুন বছরে সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে নতুন সরকারকে।’
গার্মেন্টস সেক্টরে মাঝে মধ্যে যে অস্থিরতা দেখা যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখাও সরকারের আরেকটা চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে, সেখানে শ্রমিকদের সুবিধাবঞ্চিত করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগ করবে। ফলে শ্রমিকদের বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
এ বিষয়ে এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনীতি। রাজনীতি ঠিক হলে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। সেটা অর্থনীতি বলেন আর শ্রমনীতি বলেন। কিন্তু নতুন বছরে আমরা কী ভালো রাজনীতি পাব? পাব না? তাহলে সবকিছুতেই আমাদের চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেটা হতে পারে অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব… সবকিছু। ফলে বিদেশিরা কী বলছে, সেটা নয়, আমাদের নিজেদের স্বার্থেই রাজনীতিটা ঠিক করা প্রয়োজন। এটা যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে মানুষও শান্তিতে থাকবে।’
ডেঙ্গু পরিস্থিতিও ভোগাতে পারে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সব অতীত রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৩ সালে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, গত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন, আর শুধু ২০২৩ সালেই সেই সংখ্যাটা ছিল এক হাজার ৬৯৭ জন। আগের ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে যত মানুষ মারা গেছেন, গেল এক বছরেই মারা গেছেন তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষ। ডেঙ্গু পরিস্থিতির এই পর্যায়ে আসার পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, সিটি কর্পোরেশনসহ প্রশাসনের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের মতো বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
শিক্ষানীতিও নিয়েও বিদায়ী বছরে অনেক আলোচনা হয়েছে। নতুন যে শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়েছে সেটা নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। শিক্ষানীতির বিষয়ে জানতে চাইলে এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘শিক্ষানীতির নামে যা করা হচ্ছে তা ভালো কিছু বলে আমার মনে হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরিক্ষা কখনোই ভালো ফল দেয় না।’
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকও মনে করেন, ‘এই শিক্ষানীতি ভালো হয়নি। ইংলিশ ভার্সনের নামে এখন শিক্ষার্থীরা না শিখছে বাংলা, না শিখছে ইংরেজি। ফলে ভবিষ্যতে আমাদের একটা প্রজন্ম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল।’
অন্যদিকে নতুন বছরের প্রথমদিন সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে ২৪৪ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা। একিউআই অনুযায়ী, সোমবার ঢাকার বাতাসকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ, ২০১ থেকে ৩০০ একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ থেকে ৪০০ একিউআই স্কোরকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। শুধু বছরের প্রথম দিন নয়, গোটা বছর ধরেই ছিল এই চিত্র। নতুন বছরে পরিস্থিতির উত্তরণে কাজ করতে হবে সরকারকে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে