দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ।
এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আর্থিকখাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা-সহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এসময় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত তিন মেয়াদে যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং এখনো কিছু কাজ অব্যাহত আছে।
আগামী নির্বাচনে আবারো বিজয়ী করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের শান্তি ও উন্নয়ন উপহার দিবো।’
এবার নির্বাচিত হলে দারিদ্র্যের হার ১১ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের কাতারে নিয়ে যাওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
সবশেষ ২০১৮ সালে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগানে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাসীন দল।
এতে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিল তারা।
এবারের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাককে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগ।
প্রায় তিন মাস ধরে কাজ করার পর নতুন ইশতেহার ঘোষণা করলো দলটি।
এর আগে ২১ ডিসেম্বর নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের শরিক দল জাতীয় পার্টি, যাতে দলটি প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারসহ মোট ২৪টি দফা উপস্থাপন করে।
যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার
আওয়ামী লীগের এবারে নির্বাচনী ইশতেহারে মোট ১১টি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
সেগুলো হলো:
১. দ্রব্যমূল্য সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো।
৬. ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৭. নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা।
৮. সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সকলকে যুক্ত করা।
৯.আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
১০. সাম্প্রদায়িকতা এবং সকল ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা।
১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।
যত প্রতিশ্রুতি
আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবারো ক্ষমতায় এলে বেশকিছু কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেগুলো হলো:
১. জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত স্মার্ট দেশ হিসাবে গড়ে তোলা হবে।
২. রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা আরো সুদৃঢ় করা হবে।
৩. আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।
৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারতিা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হবে।
৫. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার ধারা অব্যাহত রাখা হবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিক নির্যাতন, ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং মিথ্যা মামলা রোধ করা হবে। পাশাপাশি ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তা ও তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। এই আইনের অপব্যবহার রোধেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।
৪. জনকল্যাণমুখী, জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। এ লক্ষ্যে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ, উদ্যোগী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত ও জনকল্যাণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলমান থাকবে। এছাড়া দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ সর্বপ্রকার হয়রানির অবসান ঘটানোর কাজ চলমান থাকবে।
৫. জনবান্ধব, স্মার্ট ও আধুনিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলা হবে।
৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।
৭. সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে।
৮. স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা আরো সম্প্রসারণ করা হবে।
৯. বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করা হবে।
১০. অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারিখাতের গুরুত্ব অব্যাহত রাখা হবে।
১১. আর্থিকখাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমন করা হবে। এক্ষেত্রে পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১২. ঋণ-কর-বিল খেলাপি এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
১৩. দারিদ্র্যের ১১ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার তিন শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
১৪. প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে।
১৫. কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।
১৬. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিতে সহায়তা ও ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা হবে।
১৭. শিল্প উন্নয়ন ও বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়া অব্যাহত রাখা হবে।
১৮. দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্যাস ও এলপিজির সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে।
১৯. শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ আরো প্রসারিত করা হবে।
২০. মৌলিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবা উন্নত ও সম্প্রসারিত করা হবে। এ লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি নাগরিককে একটি ইউনিক হেলথ আইডি দেয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে অটোমেশন ব্যবস্থা চালু করা হবে।
২১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা, দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা এবং পানি সম্পদ রক্ষায় ইতিমধ্যেই যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হবে।
২২. বাংলাদেশের পাশাপাশি এই অঞ্চল থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া টাস্কফোর্স গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে আওয়ামী লীগ।
এর আগে, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘দিন বদলের সনদ’ স্লোগানে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ।
এতে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
তখন দলটির এই ইশতেহার রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলেছিল এবং নির্বাচনেও তারা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল।
এরপর টানা ১৫ বছর ধরে দেশ শাসন করে চলেছে আওয়ামী লীগ।
এই সময়ের মধ্যে আরো দু’টি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে তারা।
এর মধ্যে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘোষিত ইশতেহারে দলটির স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’।
এতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি