মহান বিজয় দিবস আজ। ১৬ ডিসেম্বর—বাঙালির হাজার বছরের গৌরব, বীরত্ব ও আত্মদানে মহিমান্বিত অর্জনের দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিন। মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন ভূখণ্ডের জানান দেওয়ার দিন।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বীর বাঙালি। এদিন ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবনত মস্তকে অস্ত্র নামিয়ে গ্লানিময় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল।
দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথম প্রহরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ।
যেভাবে সূচনা হয় মহান মুক্তিযু্দ্ধের
পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিরোধ শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। এরপর ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান যেন একেক স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে থাকে। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালিদের ওপর চালায় মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে হানাদারদের প্রতিরোধের আহ্বান জানান।
৫২ বছরে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সব সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছি। এটা নিঃসন্দেহে খুশির খবর, তেমনি আমরা যখন স্বাধীনতা চার মূলনীতির কথা স্মরণ করি তখন কিন্তু অনেক পেছনে আছি। দেশের গণতন্ত্র নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রের কথা মুখে বললেও সেটা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার সবাই শরিক হন এ লড়াইয়ে। লক্ষ্য স্থির রেখে শত্রু হননে দৃঢ়তায় এগিয়ে যায় বীর বাঙালি। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। মুক্তিবাহিনীর কাছে মাথা নত করে পাকিস্তানি ঘাতক দল। পৃথিবীর বুকে অর্ধশত বছর আগের এই দিনে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। বাঙালি ঊর্ধ্বলোকে তুলে ধরে প্রাণপ্রিয় লাল-সবুজ পতাকা।
স্বাধীনতার মূলনীতি কতটুকু আছে বাংলাদেশ?
মুক্তিযুদ্ধে মূল প্রত্যাশা ছিল বৈষম্য ও শোষণহীন একটি স্বাধীন দেশ। যেখানে সবার গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থাকবে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এই চার নীতির ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫২ বছরে প্রত্যাশার পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্ন রয়েই গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৫২ বছরে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সব সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছি। এটা নিঃসন্দেহে খুশির খবর, তেমনি আমরা যখন স্বাধীনতা চার মূলনীতির কথা স্মরণ করি তখন কিন্তু অনেক পেছনে আছি। দেশের গণতন্ত্র নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রের কথা মুখে বললেও সেটা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চার নীতি থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশ। এটার কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের দোসররা ক্ষমতায় ছিল। তারা এসব নীতি থেকে সরে যাওয়া শুরু করে; যা আজও চলছে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের ভূমিকা রয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য । এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই হবে রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ।
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা দিক নিয়ে এখন কাজ হওয়া প্রয়োজন। তথ্য প্রবাহের সুযোগ যেমন তরুণরা ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি সাংবাদিকদের দায়িত্ব আছে মুক্তিযুদ্ধকে গুরুত্ব দিয়ে ভিন্নধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
দিনের কর্মসূচি
যেসব বীর সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে এই পতাকা ও মানচিত্র এসেছে, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়েই দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণকারী আমন্ত্রিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যগণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
মুক্তিযুদ্ধের চার নীতি থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশ। এটার কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের দোসররা ক্ষমতায় ছিল। তারা এসব নীতি থেকে সরে যাওয়া শুরু করে; যা আজও চলছে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের ভূমিকা রয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য । এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই হবে রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী প্রদান করছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। এ উপলক্ষ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে।
এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। দেশের সকল শিশু পার্ক ও জাদুঘর সমূহ বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং সিনেমা হলে বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হবে।
সূর্য সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ভিড়
মহান বিজয় দিবসের সূচনা লগ্নে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ লাখো জনতা। এসময় ফুলে-ফুলে ভরে উঠবে স্মৃতিসৌধের মূল শহীদ বেদী। শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, বিদেশি কূটনৈতিকবৃন্দ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনসহ নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এসময় তাদেরকে দেওয়া হবে তিন বাহিনীর গার্ড অব অনার। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদনের পরপরই স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে। মহান বিজয় দিবসকে স্বাগত জানাতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আজ সরকারি ছুটি। রাজধানীর পাড়া-মহল্লা, সড়কের মোড়ে মোড়ে বাজবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর মুক্তির অবিস্মরণীয় গান। বাড়ির ছাদের কার্নিশে, অফিস-আদালত, দোকানপাটে, অনেক যানবাহনে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা। ইতোমধ্যে আলোকসজ্জা করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও সড়কে।