নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমেছে। সারা বছর শ্রেণীকক্ষের বাইরে হাতে কলমে শিক্ষা আর বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নেও পাঠ্যবইয়ের নেই তেমন কোনো গুরুত্ব। আগের নিয়মে পরীক্ষা না থাকায় অভিভাবকদের মধ্যেই ক্ষোভ আর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগে এখন পাঠ্যবইয়ের তুলনায় নানা ধরনের উপকরণে থাকে ঠাসা। পড়াশোনায়ও তেমন আগ্রহ নেই। বছরের শুরু থেকে অভিভাবকদের অনেকেই নতুন কারিকুলাম নিয়ে তীব্র সমালোচনা করলেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত বছর শেষে এসে রাজপথে নেমেও প্রতিবাদ করছেন অভিভাবকরা। তারা আগের পরীক্ষাপদ্ধতি ফিরিয়ে এসে নতুন কারিকুলাম সংশোধন করারও দাবি জানিয়েছেন। এরই মধ্যে দাবিদাওয়া নিয়ে আগামীকাল শুক্রবার ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে বিক্ষুব্ধ অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা নতুন কারিকুলামে সন্তুষ্ট নন। কারণ কারিকুলামে শিখন কৌশলে শিক্ষার্থীরা আগের মতো শিখতে পারছে না। এখানে অনেক বিষয়ে ভালো করার সুযোগ থাকলেও সেই সাথে শিক্ষার্থীদের ফাঁকি দেয়ারও অনেক সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে গ্রুপভিত্তিক কাজে একজনের কাজ দিয়েই পুরো ক্লাসের কাজ চালিয়ে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা নতুন এই কারিকুলামে কোনো কিছুই শিখতে বা বুঝতে পারছে না। তারা ক্লাসের অন্যদের ওপরেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
অভিভাবকরা আরো জানান, আগের মতো ক্লাসে পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের পথও বন্ধ। ফলে অনেক সুবিধা আর মেধা বিকাশের নানা পদ্ধতির কথা বলা হলেও বছর শেষে নতুন কারিকুলামের ফলাফল অশ্বডিম্ব বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। তাই আগের মতো পরীক্ষাপদ্ধতি ফিরিয়ে এনে নতুন কারিকুলাম সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিও জানিয়েছেন তারা। নয়া দিগন্তের সাথে আলাককালে অনেক অভিভাবক জানান, এখন শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগে বইয়ের পরিবর্তে নানা ধরনের উপকরণ থাকে। তারা স্কুলে গিয়ে এসব উপকরণের সাহায্যে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও হাতের কাজের পরীক্ষা দিয়ে মেধার পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয়েই তারা বেখবর।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের স্কুলের সামষ্টিক কাজের জন্য প্রতিদিনই স্কুলব্যাগে করে বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে কাগজ ও রঙিন পেন্সিল/কলমের পাশাপাশি ঘাম, মার্কার, আর্ট পেপার, পোস্টার স্কুল নিয়ে যেতে হয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলার উপকরণও নিতে হয়। ব্যাটবল, রেকেট, রশি, নেটসহ অন্যান্য খেলার উপকরণও শিক্ষার্থীদেরকেই সংগ্রহ করে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। আবার কৃষিশিক্ষা বা জীবনজীবিকা পাঠের জন্য মাটি গাছের চারা, পাত্র স্কুলে নিতে হয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ের জন্য ফাস্ট এইড বক্সের মধ্যে নানা ধরনের চিকিৎসা উপকরণও ক্লাসে নিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এর বাইরে মশারি, বিছানার চাদর, বালিশ স্কুলে নিতে হচ্ছে তাদের।
আবার শিল্প ও সংস্কৃতি ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খাবার রান্নার উপকরণ তাদেরকেই স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। বেসরকারি একটি মাধ্যমিক স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর নাহিয়ান তাওহীদ নামের এক শিক্ষার্থী তার নোট খাতায় লেখা শিক্ষা উপকরণের এমন প্রায় ৮৬টি আইটেমের নাম এই প্রতিবেদকের কাছে জমা দিয়েছে। সেখানে এমন সব উপকরণের নাম দেখা গেছে যা একটি সচ্ছল পরিবারেও সচরাচর মিলবে না।
সূত্র মতে, গত জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকেই প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকে মোট তিনটি শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম চালু হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম চালু হয়েছে। এর মধ্যে আগামী ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে আরো চার শ্রেণীতে চালু হচ্ছে নতুন এই কারিকুলাম। প্রাথমিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের অষ্টম এবং নবম শ্রেণীতেও চালু হচ্ছে নতুন কারিকুলাম। অভিভাবকদের অনেকেই বলছেন গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমাদের সন্তানরা আসলে কিছুই শিখতে পারছেন না। শ্রেণিকক্ষের পঠন ও শিখন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরাও নতুন কারিকুলামের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছেন না।
অভিভাবকদের মতে আগের পুরাতন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বাসায় এসে যেভাবে পড়াশোনায় মনোযোগী থাকত এখন তার ছিটেফোঁটা আর নেই। বাসায় টেবিলেই বসতে চায় না শিক্ষার্থীরা। বাবা-মা বারবার পড়ার জন্য তাগিদ দিলেও শিক্ষার্থীরা বলে বাসার জন্য কোনো পড়া দেননি শিক্ষকরা। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরাই বাসায় এসে অলস সময় কাটায়। আর আগের মতো স্কুলে বা ক্লাসে পরীক্ষা না থাকায় মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
কয়েকজন অভিভাবক নয়া দিগন্তকে জানান, নতুন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তথা নতুন কারিকুলাম আমাদের সন্তানদের শিক্ষার ভিত নষ্ট করে দিচ্ছে। যেখানে শিক্ষকরা নিজেরাই নতুন কারিকুলাম ভালো করে বুঝতে পারেন না, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের কী পাঠদান করবেন? তাদের মতে প্রথমে কাঠামো তৈরি করে তারপর এটা কয়েকটি বিষয়ের ওপর চালু করা উচিত ছিল। পরীক্ষা পদ্ধতি ছাড়া মেধা মূল্যায়নের মতো বিষয়টি অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যেখানে পরীক্ষার জন্য বই পড়তে চাইত না, সেখানে বাচ্চারা পরীক্ষাহীন লেখাপড়ায় বইয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখছে না। আমাদের সন্তানরা এখন মোবাইল, ট্যাব এগুলো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। শিক্ষকরা ইন্টারনেট থেকে সব লিখে আনতে বলে। যেখানে সারা বিশ্ব ডিভাইস থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে আমরা উৎসাহিত করছি এগুলো ব্যবহার করার জন্য।
এদিকে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সংস্কারসহ ৭ দফা দাবি জানিয়েছে শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম। অভিভাবকদের অনেকেই বলেন, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সংস্কার করতে হবে। এছাড়া আগের পরীক্ষাপদ্ধতিও ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে মেধা যাচাই হবে নম্বরের ভিত্তিতে। আর সব ব্যবহারিক বিষয় স্কুল থেকে সম্পন্ন করতে হবে। নতুন কারিকুলাম পরিবর্তন করতে হবে এবং যেকোনো পরিবর্তন পরিমার্জন করতে হলে ওই কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি রাখতে হবে। এছাড়া অযৌক্তিকভাবে পরীক্ষা ফি ও বেতনও আর বাড়ানো যাবে না। শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরামের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র আমিরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা নতুন কারিকুলাম সংশোধনের জন্য আগে থেকেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি জানিয়ে আসছি। এখন সরকার যদি আমাদের দাবি না মানেন তাহলে আগামীকাল শুক্রবার সকালে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরা অভিভাবকদের নিয়ে সমাবেশ করব। সেখান থেকেই আমরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।