২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশ ও সংঘাতের পর থেকে ব্যাপক গ্রেফতার ও মামলায় জর্জরিত এখন বিএনপি। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আটক করছে পুলিশ।
এমন প্রেক্ষাপটে সারাদেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক কাজ করছে। ঢাকায় পুলিশ হত্যা ও নাশকতা মামলা এবং পরবর্তীকালে অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মামলা হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে।
বিএনপি এই অভিযানকে বলছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘পরিকল্পিত একটি ক্র্যাকডাউন’ চলছে।
২৮ অক্টোবর ঢাকার সমাবেশে সহিংসতার পর থেকে নরসিংদী জেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সালমা আক্তার বাড়িতে থাকছেন না।
গ্রেফতার এড়াতে রাতে সপরিবারে নিরাপদ জায়গায় থাকার চেষ্টা করেন সালমা আক্তার। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি, কিন্তু তার পরেও দলীয় পদে থাকা এবং পুলিশে তৎপরতা দেখে গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন তিনি।
সালমা আক্তার জানান, নরসিংদী জেলা বিএনপির বিভিন্ন স্তরের দেড় শতাধিক নেতাকর্মী জেলে আছেন। যারা বাইরে আছেন তারাও গ্রেফতার আতঙ্কে কেউ বাড়িঘরে থাকছে না।
‘আমাদের তো প্রতিনিয়ত বাড়ির বাইরে থাকতে হচ্ছে। আমি মহিলা হওয়ার পরেও এ অবস্থা। সারা বাংলাদেশের নেতা-কর্মীরা যেভাবে অবরুদ্ধ জেলে এবং হয়রানির শিকার হচ্ছে নরসিংদীতে এটা আমার মনে হচ্ছে অনেকাংশে বেশি, বিবিসি বাংলাকে বলেন সালমা আক্তার।
নরসিংদী জেলা যুবদলের একজন নেতা হাসিব সারোয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনিও ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন।
‘নরসিংদীতে যুবদলের ১৫১ জনের কমিটি আছে। এর মধ্যে যুবদলের ৭০ জনই কারাগারে। এখন তো মনে করেন বাসায় গিয়ে না পেলে বাসায় ছোট ভাই বা যদি উপযুক্ত সন্তান থাকে তাকেও পুলিশ গ্রেফতার করার চেষ্টা করে। এই জন্য পুরো পরিবারই গ্রেফতার আতঙ্কে আছে,’ বলছিলেন সারোয়ার।
শুধু নরসিংদী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম পরিস্থিতি বলেই জানা যাচ্ছে।
ঢাকাসহ সারাদেশে মামলা এবং পুলিশের অভিযানে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ১২ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করছে বিএনপি ।
এ অবস্থায় পুলিশ বলছে, ২৮ অক্টোবর পুলিশ হত্যা ও সহিংসতা এবং অবরোধে সহিংসতার কারণে অভিযান চলছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী ২৮ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ১১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার এবং গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ৭০০ জন।
অন্যদিকে বিএনপির দাবি ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০০ মামলা হয়েছে।
বিএনপির দাবি, এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার এবং ১২ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবে এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতর কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল অভিযোগ করেন, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সারাদেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে এসব মামলা দিয়ে সরকার একটি ‘ক্র্যাকডাউন’ চালাচ্ছে।
‘এই পুরো প্রক্রিয়াটা মনে হচ্ছে একটা স্টেইট স্পন্সরড প্রিপ্ল্যানড ক্র্যাকডাউন ( রাষ্ট্রীয় মদদে পূর্ব পরিকল্পিত)। বিএনপি করে এমন লোকজন তো আছেই, তাদের আত্মীয়-স্বজনও নাজেহালের শিকার হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন কায়সার কামাল।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব মামলা বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা হচ্ছে। মামলার এজাহারে বিএনপির অধিকাংশ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে আসামী করা হচ্ছে।
কায়সার কামাল বলছেন, যেভাবে মামলা দেয়া হচ্ছে এবং আসামি করা হচ্ছে, সেটি উদ্বেগজনক।
‘বিশেষ আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিতে না পারেন। তার মানে হলো, যখন একজন অ্যারেস্ট হলো জামিন পাচ্ছে না। কারণ আইনেই বলা আছে যে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কোনো এখতিয়ার নেই জামিন দেয়ার।’
‘অর্থাৎ তার কারাবাস দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পরবর্তীতে কেউ যদি গিয়ে হাজিরও হয় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তাকেও জেলে যেতে হচ্ছে,’ বলেন কায়সার কামাল।
২৮ অক্টোবর পরবর্তী ধরপাকড়ের শুরুতেই আটক হন বিএনপির মহাসচিব। এরপর একে একে দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
শুধু ঢাকা মহানগরীতেই গত ১০ দিনে ১১৭টি মামলায় দেড় হাজার বিএনপি নেতা-কর্মী আটক করা হয়েছে বলে তথ্য দিচ্ছে পুলিশ।
ডিএমপির মুখপাত্র মো: ফারুক হোসেন বলেন, পুলিশ হত্যা ও সহিংসতার মামলায় সারাদেশ থেকে ঢাকায় এসে যারা জড়িত ছিল সবাইকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
‘এটা তো একটা ব্যাপক অভিযান চলছে বলাই যায়। সারা দেশ থেকে ঢাকায় তাদের লোক সমাগম হয়েছিল। ঢাকা মহানগরে যে ৪০টির মতো মামলা রেকর্ড হয়েছে, এসব মামলার আসামি কিন্তু সারাদেশে বিস্তৃত।’
‘ফলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশনা বা আমাদের নির্দশনায় যেসব আসামির বাড়ি যেসব এলাকায় আছে, জেলা শহরে আছে বা কোনো গ্রামগঞ্জে আছে- তাদেরকেও কিন্তু ওই জেলার পুলিশ গ্রেফতার করবে এবং এই মামলায় আমাদের কাছে চালান দেবে,’ বলেন ডিএমপি মুখপাত্র।
২৮ অক্টোবরের পর অনেকটা ঘোষণা দিয়েই সরকার এখন বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে। বিএনপিও হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে এ পরিস্থিতি জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি