সাভারে একটি তৈরী পোশাকের সহযোগী শিল্প কারখানা রয়েছে ‘ক’ নামক একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তার। চলমান পরিস্থিতিতে তিনি এলসি খুলতে পারছেন না। ব্যাংক থেকে আগের মতো বিনিয়োগও পাওয়া যাচ্ছে না। ডলার সঙ্কটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তার ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে আসছেন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে। সামনে বাকি অর্ধেকের বেতন জোগাড় করতে পারবেন কী না তা নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন। ওই ব্যবসায়ীর মতো বেশির ভাগেরই একই অবস্থা। অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকের বেতন-ভাতার সংস্থান করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে সঙ্কুচিত করে ফেলছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি বিনিয়োগের এ বেহাল অবস্থার ইঙ্গিত রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বরে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত প্রায় দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বেসরকারি বিনিয়োগের বেহাল হওয়ার এ করুণ চিত্রের জন্য মূলত তিনটি প্রধান কারণকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এর অন্যতম কারণ হলো ডলার সঙ্কটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে পণ্য আমদানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপর দিকে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংক। প্রতিদিনই অনেক ব্যাংক নগদ টাকার সঙ্কটে ভুগছে। একশ্রেণীর ব্যাংক প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। গত ১ নভেম্বর ২৬টি ব্যাংক ১৭ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা ধার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এতে সুদ গুনতে হয়েছে সর্বনিম্ন সোয়া ৭ শতাংশ থেকে সোয়া ৯ শতাংশ পর্যন্ত। তৃতীয়, কারণ হলো ব্যাংক খাত থেকে সরকার আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস ১৮ দিনে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আর গত ১৮ অক্টোবর শেষে স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বেসরকারি ঋণ প্রবাহে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্টে শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে তা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণে এই প্রবৃদ্ধি গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর পর কখনোই তা ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। গত সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতের এই ঋণের প্রবৃদ্ধির চিত্র মূলত ঋণাত্মক হয়েছে। কারণ, ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার এখন প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি। ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান ঋণের সাথে ৯ শতাংশ সুদ যুক্ত করলে এমনিতেই বছর থেকে ১০০ টাকার ঋণের সাথে ৯ টাকা যুক্ত হয়ে যায়। সেই হিসাবে প্রকৃত বিনিয়োগের চিত্র ঋণাত্মকই।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার অর্থই হলো সরাসরি কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়া। কারণ, দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রাখে বেসরকারি বিনিয়োগ। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এক হিসাবে প্রতি বছরই দেশের কর্মসংস্থানে প্রতি বছরই ২৫ লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এখন বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান না বাড়লে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। যেখানে বিদ্যমান কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে নতুন কর্মসংস্থান কীভাবে শ্রমবাজারে ঢুকবে। এতে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। কারণ, বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।