সহিহ মুসলিম শরিফের এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হজরত মাসতুর ইবনে শাদ্দাদ (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর শপথ! পরকালের তুলনায় দুনিয়ার উপমা শুধু এতটুকুই যেমন তোমাদের মাঝে কেউ নিজের একটি অঙ্গুলি সমুদ্রের পানিতে চুবিয়ে তুলে নিল। অতঃপর দেখ তাতে কতটুকু পানি লেগে এসেছে।’ -সহিহ মুসলিম শরিফ এই হাদিস দ্বারা মহানবী (সা.) এই বিষয়টিই স্পষ্ট করার উদ্দেশ্য যে, আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া একেবারেই অস্তিত্বহীন, দুনিয়াকে কোনোভাবেই আখেরাতের সঙ্গে তুলনা দেয়া যায় না। অসংখ্য হাদিসেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ার স্থায়িত্বহীনতা এবং তার অসারতা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, শ্রোতারা যেন দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্টহীন হয়ে আখেরাতের প্রতি ধাবমান হয়। এসব হাদিসের সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে একথাও মেনে নেয়া অপরিহার্য মনে করছি যে, ইসলাম বৈরাগ্যবাদ কিংবা দুনিয়ার তরক করার শিক্ষা কখনও দেয়নি, বরং দুনিয়ার প্রয়োজনকে সঠিক পন্থায়, সঠিক পদ্ধতিতে পূরণ করা শুধু জায়েজই নয় বরং তাকে ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে কঠোর ভাষায় দুনিয়ার ভালোবাসা, লোভ-লালসা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, যেমনিভাবে এই দুনিয়ার ভেতর আমাদের জীবনযাপন একটি জীবন্ত বাস্তবতা, একইভাবে পরকালের জীবনও এক অনস্বীকার্য জ্বলন্ত বাস্তবতা। যার সংবাদ সব নবীই দিয়ে গেছেন। পরকালের জীবন অবশ্যই আমাদের দৃষ্টির অগোচরে; কিন্তু তার দৃষ্টান্ত একেবারে এমনই যেমন শিশু তার মায়ের পেটের ভেতর অবস্থান করার সময় ভাবতে থাকে, এটিই হলো বিশ্বজগত। কেননা তখন তার সামনে বিশাল এই দুনিয়া বিরাজমান থাকে না। এর দ্বারা যেমনি দুনিয়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না, একইভাবে দুনিয়ার ভেতর অবস্থানকালে পরকাল দৃষ্টিগোচর না হওয়াতে তার অস্তিত্বহীনতারও দাবিদার হওয়ার কোনো অর্থ হতে পারে না। বরং প্রকৃত সত্য ও বাস্তবতা এটিই- ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবনটা একেবারেই সীমিত, আর পরকালের জীবন অনন্ত, অফুরন্ত। আর দুনিয়ার জীবনের মুখ্য এবং একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে নিজের আখেরাতের সফল জীবনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া। তবে দুনিয়ার মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা এটিই পরিলক্ষিত হয় যে, যেহেতু দুনিয়া সব সময় তাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান, আর আখেরাত তাদের নজরের বাইরে, এই কারণে আখেরাত বিশ্বাসীদের অন্তরেও দুনিয়ার চিন্তা-ফিকিরটার প্রভাবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। তার সব চেষ্টা-প্রচেষ্টা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, চিন্তা-ফিকিরের পূর্ণ শক্তিই দুনিয়ার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যয়িত হয়। আর ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, শতভাগ পরকালীন চিন্তা তার মাঝে আর থাকে না। তখনই মানুষ দুনিয়ার চাকচিক্যে বিভোর হয়ে পরকালের অনন্তকালের জীবনকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দেয়। এর দৃষ্টান্ত এখন হতে পারে যেমন ছোট বাচ্চাদের পুরো আকর্ষণটাই থাকে খেলাধুলা আর ঘোরাফেরার প্রতি। শিক্ষা-দীক্ষা যা তার ভবিষ্যৎ সফল জীবন বিনির্মাণের কবচ, তা তার কাছে থাকে একেবারেই আকর্ষণহীন বরং মাথার বোঝা। কিন্তু দয়াশীল মাতা-পিতার কাজ হলো তারা সন্তানকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে খেলাধুলা আর শিক্ষা-দীক্ষার পার্থক্য নির্ণয় করে দেবেন। তারা সন্তানকে একথা বলে দেবেন, খেলাধুলা পরিণতিতে শিক্ষা-দীক্ষার তুলনায় কোনো কিছুই নয়, শিক্ষার তুলনায় এর কোনো মূল্যই হতে পারে না। ঠিক একইভাবে নবীরা, যারা মানবজাতির জন্য পিতৃতুল্য বরং তাদের চেয়ে অনেক দয়াবান, মেহেরবান, তারা নিজ অনুসারীদের সামনে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত-উপমা দিয়ে বিভিন্ন পন্থা-পদ্ধতিতে দুনিয়া-আখেরাতের পার্থক্য সুস্পষ্ট করেছেন। উদ্দেশ্য একটিই, যেন মানবজাতি দুনিয়ার ধান্ধায় জড়িয়ে আখিরাতের জীবন ভুলতে না বসে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই দৃষ্টান্ত হাদিসে তুলে ধরেছেন যে, অথৈ সাগরের পানিতে যেমনিভাবে আঙ্গুল ভেজানো পানির কোনো অস্তিত্ব হতে পারে না, এটি যেমনিভাবে একেবারেই একটি উল্লেখ করার বিষয় নয়, সমুদ্রের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততাই হতে পারে না। একইভাবে পরকালের তুলনায় দুনিয়াও একেবারেই অস্তিত্বহীন। কেননা দুনিয়ার এই জীবনটা খুব বেশি হলে ষাট-সত্তর বছর, এর চেয়েও বেশি হলে আশি-নব্বই বছরেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আখেরাতের জীবন সীমাহীন, অনন্ত, অফুরন্ত। তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। সুতরাং দুনিয়ায় অবস্থানকালে তোমাদের জন্য বৈধ সব উপকরণ থেকে উপকৃতি লাভ জায়েজ। কিন্তু জীবনের উপকরণে মত্ত হয়ে পরকালের জীবনকে ভুলে যাওয়া, তার চিন্তা-ফিকির থেকে গাফেল থাকাটা এমনই, যেমন কোনো ব্যক্তি তার লেখাপড়ার পুরো সময়টাই খেলাধুলায় এবং হেলাফেলায় কাটিয়ে দিয়েছে। নিজের ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবন গঠনে শিক্ষা অর্জনের কোনো চিন্তা-ফিকিরই সে করেনি। সে তার জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে একেবারে যেনতেন উপায়ে। পরকালের জীবন ভুলে যাওয়ার মাশুল হবে এর চেয়ে ভয়াবহ। কেননা দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দুনিয়ার খারাপ আমলের সংশোধন তখন আর কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না।