২৮ অক্টোবর ঘিরে বেশ কিছুদিন ধরে রাজনীতিতে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশের বিবদমান বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। দুই দলই রাজপথ দখল-পাল্টা দখলের লড়াইয়ে অনড় অবস্থানে ছিল। বিএনপি ও তার মিত্ররা চায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হোক। অবশ্য ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকেই তারা তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। আর শাসকদল আওয়ামী লীগ চায়- সংশোধিত সংবিধানের আলোকে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের ফলে দেশের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞসহ সাধারণ মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যেই শেষমেশ সঙ্ঘাতেই গড়াল রাজনীতি।
২৮ অক্টোবর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জামায়াত শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করতে পারলেও বিএনপির মহাসমাবেশ হামলা ও সংঘর্ষে পণ্ড হয়ে যায়। দিনভর নানা উত্তেজনায় থাকা রাজনৈতিক অঙ্গন শেষ বিকেলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-পুলিশ ত্রিমুখী ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ, গুলি সাউন্ডগ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসব ঘটনার মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য ও একজন যুবদলকর্মী নিহত হন। সাংবাদিকসহ অনেকেই আহত হন। এরপরই গতকাল সারা দেশে হরতাল পালন করে টানা তিন দিনের অবরোধ ঘোষণা করেছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তবে সঙ্ঘাতময় হয়ে ওঠা রাজনীতির সমাধান সংলাপেই ভরসা পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতীতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে দেশের রাজনীতি যতই উত্তপ্ত ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি হয়ে উঠুক না কেন তা নিরসনের পথ হচ্ছে সংলাপ। ১৯৯০ সালেও এদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছিল। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালেও রাজনীতি অনেক উত্তপ্ত ছিল। ওই সময় রাজনৈতিক ময়দান সঙ্ঘাত সংঘর্ষে রূপ নিয়েছিল। শেষমেশ সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে তখনকার বিএনপি সরকার আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। দেশে বর্তমানে সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। এই সঙ্ঘাতময় পরিবেশ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো দেশের বিবদমান বড় দুই দলের মধ্যে দ্রুত শর্তহীন একটি সংলাপ অনুষ্ঠান। যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে ২০১৩-১৫ সালে যেমন রাজনীতি সহিংস হয়ে উঠেছিল তারচেয়েও ভয়ঙ্কর হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারবিরোধী দলগুলোর দেয়ালে পিঠ একেবারে ঠেকে গেছে। সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও তা স্বীকার করে বলছেন, তাদের (বিএনপি) পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা এবার মরণ কামড় দেবে। এজন্য সরকারি দলও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলাকে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখছে। তাদের প্রতিহত করার জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার জন্যও আহবান করা হচ্ছে। দুই দলের অনড় অবস্থানে দীর্ঘদিন পর রাজনীতিতে নতুন করে হরতাল অবরোধ শুরু হয়েছে। এটা দেশের জন্য অশনিসঙ্কেত। ফলে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সংলাপের বিকল্প দেখছেন না বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, দেশের এই রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে বড় দুই দলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মধ্যে দ্রুত একটি সংলাপ-সমঝোতা হতে হবে। সঙ্ঘাতের বিকল্প হলো সংলাপ। সঙ্কট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল পরিবেশ আমরা দেখছি না। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা নির্বাচনের পরিবেশ আরো ঘোলাটে হয়েছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গেলে নির্বাচন কমিশনকেই আগে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তারপর তফসিল ঘোষণার চিন্তা করা ভালো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৯৯০, ’৯৬ ও ২০০৮ সালেতো আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা এবং ঐকমত্যে পৌঁছানো। জন-আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ’৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির এদেশে আছে। তাহলে জন-আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে আরেকবার সংবিধান সংশোধন করতে সমস্যা কোথায়? এখানে দেখার বিষয়, বিরোধী দল যে দাবি করছে তাতে জনসমর্থন আছে কি না, জনগণ কী চায়? জনগণ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, যে নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। ইকতেদার আহমেদ বলেন, সরকারি দল হয়তো বলবে, এটাতো সংবিধানে নেই। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জন-আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনায় সংবিধান সংশোধন সরকার করতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো দরকার। এর জন্য বড় দুই দলের মধ্যে দ্রুত সংলাপও হতে পারে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার জন-আকাক্সক্ষা উপেক্ষা করে যদি অতীতের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন করতে চায় তাহলে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না, এর ফলও ভালো হবে বলে মনে হয় না।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ২৮ অক্টোবর যা হয়েছে সেটা সঙ্ঘাত বলা যায় না। সঙ্ঘাত সংঘর্ষ হলো দুই পক্ষকে মুখোমুখি হতে হয়। সেটাতো হয়নি। যা হয়েছে তাহলো আওয়ামী লীগের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। কারণ বিদেশীদের কাছে আওয়ামী লীগ একটা বার্তা দিতে চেয়েছে তাহলো- তোমরা যারা বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছো দেখ, তাদের এদেশে কোনো জনসমর্থন আছে কিনা। যারা রাজনৈতিক ময়দানে আধা ঘণ্টা টিকতে পারে না তোমরা সেই দুর্বল শক্তির পেছনেই ছুটছো আর একটি বড় শক্তিকে তোমরা অবহেলা করছো। তোমরা ভুল পথে আছো। এ বিষয়টি আমেরিকা কিভাবে নেয় সেটা এখন দেখার বিষয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি অনুকূল পরিবেশ চেয়েছিল ২৮ অক্টোবর ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সেটা পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন যেকোনো মূল্যে তফসিল ঘোষণা করবে এবং একতরফা নির্বাচনের পথেই শুধু হাঁটবে না, একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব আয়োজন, সব প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করবে। এটার ফল মনে হয় না ভালো হবে। তবে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করলে, জনমতের প্রতি গুরুত্ব দিলে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা এই সঙ্কট সমাধানে বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে শর্তহীন একটা সংলাপ হওয়া দরকার। সেটি সহসা হবে এমন প্রত্যাশাও করা যায় না।
এদিকে সংলাপ-সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে না। সংশোধিত সংবিধানের আলোকে যথাসময়ে নির্বাচন করার পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। ওই নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ না করলেও বাড়তি কোনো চাপও অনুভব করছেন না দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এমনটি আভাস দিয়েছেন। গতকাল নয়া দিগন্তকে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যে ষড়যন্ত্র চলছে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একধাপ এগিয়ে গেল আওয়ামী লীগ। বিএনপির মহাসমাবেশে সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন দেখলাম না। আর সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন না থাকলে সেই আন্দোলন সফলতা পায় না। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করে কোনো লাভ হবে না, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি-জামায়াত যদি আবারো সহিংসতা করতে চায় তাহলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে আওয়ামী লীগ কোনো সহিংসতায় জড়াবে না।