সরকার পতনের একদফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও দলটির সঙ্গীরা যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে আসছে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিলেও দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটকে রাজপথে সেভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে না। সবশেষ আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিরোধীরা। একই দিনে পাল্টা সমাবেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ একাই। তবে মাঠে নেই ১৪ দলের শরিকরা। ২৮ অক্টোবর নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও শরিকদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনও আলোচনা করেনি আওয়ামী লীগ। শরিক দলগুলো নির্বাচনমুখী তৎপরতায় ব্যস্ত থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় জোটগত কর্মসূচি চান তারা। এমতাবস্থায় মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) বিকাল ৩টায় ১৪ দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে।
১৪ দলের শরিক কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, সরকার পতনের একদফা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে সমমনা দলগুলো। তাদের মোকাবিলায় মাঠে একাই নামছে আওয়ামী লীগ। শরিক দলগুলোর সঙ্গে কর্মসূচি নিয়ে কোনও আলোচনা হচ্ছে না, কোনও নির্দেশনাও আসছে না। সে কারণে শরিকরা নিজ নিজ দলের কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি নির্বাচনমুখী তৎপরতায় ব্যস্ত থাকছে। তবে নির্বাচন সন্নিকটে চলে আসায় এখন অন্তত জোটগত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে চান নেতারা।
আগামী ২৮ অক্টোবর (শনিবার) রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি, যাতে দলটির যগপৎ সঙ্গী দলগুলোর অংশ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। বিরোধী শিবিরে চলছে সে অনুযায়ী ব্যাপক প্রস্তুতিও। একই দিনে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এতে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর যোগ দেওয়া নিয়ে এখন পর্যন্ত আলোচনা না হলেও আওয়ামী লীগ নিজেদের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, ‘একটি বৈঠকে জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলায় কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে আওয়ামী লীগ। তবে ১৪ দলের পক্ষ থেকেও বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছরে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠক হয়েছে ১৪টির মতো। এসব বৈঠক হয়েছে জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর বাসায়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি, জোটনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ সময়ের মধ্যে মাত্র একটি বৈঠক হয়। জোটগত কর্মসূচির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে তেমন কোনও কর্মসূচি পালন করা হয়নি। তবে সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এসে বেশ কয়েকটি সমাবেশ হয়েছে ১৪ দলের ব্যানারে। এর মধ্যে বেশি সমাবেশ ছিল শোকের মাস আগস্টে। এরপর আর কোনও কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি ১৪ দলকে।
জোটের সভায় বক্তব্য রাখছেন আমির হোসেন আমু (ফাইল ফাটো)জোটের সভায় বক্তব্য রাখছেন আমির হোসেন আমু (ফাইল ফাটো)
১৪ দলীয় জোটের কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা জোটগতভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত রুখে দিতে প্রচারণামূলক কর্মসূচি পালন করছে ১৪ দল। দলীয়ভাবেও আমরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কর্মসূচি পালন করে আসছি।’
তিনি বলেন, ‘২৮ অক্টোবর বিএনপি ও তাদের শরিক দলগুলো মহাসমাবেশ করবে। ওই দিন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে সেদিন ১৪ দলের কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। তারা দলীয়ভাবে কর্মসূচি পালন করবে, সেটি তাদের বিষয়।’
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটকে বেশ সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। জোট শরিকদের মধ্য থেকে তিন জনকে মন্ত্রীও করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরেও ১৪ দলকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে এই জোটের সক্রিয়তায় ভাটা পড়েছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শরিক নেতা।
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘বিএনপি ও তাদের যুগপৎ সঙ্গীরা সরকারকে ফেলে দিতে চায়, তাদের বাঁচা-মরার আন্দোলন এটা। এর বিরুদ্ধে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মাঠে আছে। বলাই আছে—আওয়ামী লীগ প্রয়োজন মনে করলে ১৪ দলের কর্মসূচি দেওয়া হবে। এখনও তেমন অবস্থা তৈরি হয়নি। তাই ২৮ অক্টোবর ১৪ দলের কোনও কর্মসূচি নেই। ১৪ দল এখন নির্বাচনমুখী। আর মাঠ পাহারা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আমরা এলাকায় সময় দিচ্ছি।’
অতীতের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময়ে জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তখন দরকষাকষির পাশাপাশি ঘন ঘন বৈঠকেও বসতে দেখা যায় নেতাদের। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভাটা পড়া সক্রিয়তায় গতি আনার চেষ্টা করছেন ১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতারা।
ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘১৪ দলের প্রতিপক্ষ হলো বিএনপি জোট। তাদের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ যদি নিজেকে যথেষ্ট বা একাই সক্ষম মনে করে, সেটি ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগ তো একাই কর্মসূচি পালন করছে। তারা ১৪ দলীয় জোট শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করছে না। ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি নিয়েও কোনও আলোচনা বা নির্দেশনা জোটের পক্ষ থেকে আসেনি।’
বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলায় ১৪ দলের কর্মসূচি থাকা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘জোটের সবশেষ বৈঠক হয়েছে মাস তিনেক আগে, জোটনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তারপর আর কোনও বৈঠক হয়নি। হয়তো জোটের মধ্যে আত্মসমালোচনা এড়াতে এমনটি হতে পারে। কিন্তু সামনে নির্বাচন, তাই জোটকে সক্রিয় করা উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ, ১৪ দল গঠিতই হয়েছে একটা আদর্শিক বিবেচনায়, সেই আবেদন তো এখনও বিদ্যমান।’
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে আন্দোলনটা ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি বলয়ে থাকা দলগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অংশ নিলেও ১৪ দলের শরিকরা দলীয়ভাবে কর্মসূচি পালন করছে। তবে নির্বাচন কড়া নাড়ায় জোটগত কর্মসূচি পালন করা দরকার। কারণ, ঐক্যের শক্তি আছে, সেটিকে কাজে লাগিয়েই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। এখনও সেই শক্তিকে কাজে লাগানো উচিত।’
এদিকে মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) বিকাল ৩টায় কেন্দ্রীয় ১৪ দলের এক সভা ডাকা হয়েছে। সভাটি জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর ইস্কাটনের বাসায় তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে।
সোমবার (২৩ অক্টোবর) আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।