রামেশ্বরম দ্বীপে আমি বেড়ে উঠেছি। সেই দ্বীপ আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক সময় তা ছেড়ে চলে আসতে হলো আমাকে। সমুদ্রের জোয়ার, ঢেউয়ের ওপর ঢেউ আছড়ে পড়া, পামবান ব্রিজ পাড় হয়ে যাওয়া ট্রেনের শব্দ, শহরজুড়ে উড়ে বেড়ানো পাখি, বাতাসে লবণের উপস্থিতি- এসব আমার স্মৃতিপটে এখনও সব সময় উজ্বল। আমাদের ঘিরে আছে সমুদ্র। শুধু তা-ই নয়- এখানকার প্রতিবেশী ও আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন এ সমুদ্র। এর সঙ্গে প্রায় সব বাড়ির মানুষের রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক। তাদের কেউ জেলে। কেউবা বোটের মালিক। আমার পিতাও একটি ফেরি চালাতেন। তাতে করে লোকজনকে রামেশ্বরম ও ধানুশকোড়ি দ্বীপে আনা-নেয়া করতেন। এ দু’ দ্বীপের মধ্যবর্তী অংশ ঘুরিয়ে দেখাতেন তাদের।
এ দ্বীপ দু’টির মধ্যে দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। যখন তিনি এ ধারণাটি মাথায় আনলেন এবং আমরা একটি বোট বানালাম- সেই সময়টার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে এখনও। রামেশ্বরম যেহেতু প্রাচীন, তাই এটি তীর্থযাত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, রাম যখন সীতাকে উদ্ধার অভিযানে ছিলেন তখন তিনি এখানে থেমেছিলেন এবং লংকা পর্যন্ত সেতু নির্মাণ করেছিলেন। রামেশ্বরমে যে মন্দিরটি আছে তা উৎসর্গ করা হয়েছে শিবকে। এখানে একটি ঘরে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছেন সীতা। রামায়ণের কিছু কিছু সংস্করণে বলা হয়েছে, লংকা থেকে অযোধ্যায় ফেরার পথে রাম, লক্ষণ ও সীতা এখানে থেমেছিলেন শিবের কাছে প্রার্থনা করতে। যেসব তীর্থযাত্রী এখানে আসতেন তাদের অনেকেই আমাদের শহরের। এখান থেকে ধানুশকোড়ি যেতেন। এখানে সাগরসঙ্গমে স্নান করা এক পবিত্র কর্ম। এই সঙ্গম হলো বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মিলনস্থল। ধানুশকোড়িতে এখন সড়কপথে যাওয়া যায়। তীর্থযাত্রীদের সেখানে নিয়ে যায় ভ্যান।
শৈশবের কথায় ফিরে আসি। যখন আমি শিশু সে সময়ে এ দ্বীপে যাওয়ার উত্তম উপায় ছিল ফেরি। আমার পিতার উপার্জন ভাল হতো না। তাই তিনি বিকল্প চিন্তা করতে লাগলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ফেরি নিয়ে ব্যবসা করবেন। তিনি একটি বোট নির্মাণ শুরু করলেন। প্রথম দিকে এ কাজ তিনি একাই শুরু করলেন। বোটটি নির্মাণ করা আমাদের জন্য খুব দরকারি ছিল। সমুদ্র উপকূলে চলাফেরার জন্য তা প্রয়োজন। কাঠ এবং কিছু ধাতব পদার্থের সংমিশ্রণে একটি বোটে জীবন সঞ্চারিত হতে দেখতে দেখতে সম্ভবত প্রকৌশল দুনিয়ার ধারণা প্রথম আমার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বোট বানানোর জন্য কাঠ সংগ্রহ করা হলো। আহমেদ জালালুদ্দিন নামে এক কাজিন আমার পিতাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। যেখানে বোটটি নতুন চেহারা পাচ্ছে প্রতিদিন আমি সেখানে যাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। এক রকম অধৈর্য হয়ে পড়তাম। বিশাল বিশাল কাঠ কেটে কেটে একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি দেয়া হচ্ছিল। তা শুকানো হচ্ছিল। এরপর তা মসৃণ করা হচ্ছিল। তারপর তা একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া দেয়া হয়। আগুন জ্বালিয়ে কাঠ থেকে বাকল ও অপ্রয়োজনীয় অংশ পুড়িয়ে আলাদা করা হতো। এরপর তা দিয়ে বানানো হতো গলুই। আস্তে আস্তে বোটের নিচের অংশ বানানো হলো। তারপর পাশের অংশ। এরপর শুরু হতো গলুই বানানো। এ ঘটনাগুলো ঘটেছে আমার চোখের সামনে। এর অনেক বছর পরে আমি কাজ করতে গিয়ে জানতে পারি কিভাবে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে হয়। প্রকৌশল জগতের এ মাইলফলকের মূলে রয়েছে জটিল গণিত ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা। কিন্তু ওই যে বোট, যা উপকূলে ফিরে আসতো। তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যেত। জেলেদের নিয়ে যেত। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতো- কে বলবে ওই সময় এই বোটই তখনকার জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? এই বোট তৈরির প্রক্রিয়া আমার জীবনে অন্যভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এর মাধ্যমে আমার জীবনে পবির্তন এনেছেন আহমেদ জালালুদ্দিন। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। আমার ভেতর জানার জন্য যে আকাঙক্ষা এবং আমার যে প্রশ্ন ছিল তার প্রতি তিনি ছিলেন নমনীয়। সব সময়ই তিনি আমার কথা শুনতেন ধৈর্য সহকারে। তিনিই আমাকে উপদেশ দিতেন। তিনি ইংরেজি পড়তে ও লিখতে পারতেন। বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কার, সাহিত্য ও ওষুধ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতেন। রামেশ্বরমের রাস্তায় যখনই তার সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করতাম অথবা আমরা বোটে বসে আলোচনা করতাম, তখনই মনে মনে আইডিয়া ও উচ্চাকাঙক্ষা পোষণ করতে শুরু করি। বোটের ব্যবসা বেশ সফল হয়েছিল। এ ব্যবসা চালাতে আমার পিতা নিয়োগ দিয়েছিলেন কিছু লোক। তীর্থযাত্রীদের বিভিন্ন গ্রুপ তাদের ব্যবহার করতো ধানুশকোড়ি পৌঁছাতে। এমনও অনেক দিন গেছে, যখন আমি জনতার ভিড়ের মধ্যে পিছলে পড়ে যেতাম এবং বোটে মানুষের ভিড়ে বসে পড়তাম। বোট রামেশ্বরমে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতো। আমি শুনেছি রামের গল্প এবং তিনি তার সেনাবাহিনী বানরদের সহায়তায় কিভাবে লংকা পর্যন্ত ব্রিজ নির্মাণ করেছিলেন। কিভাবে তিনি সীতাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং রামেশ্বরমে ফের থেমেছিলেন, যাতে রাবণকে হত্যার অনুশোচনা করা যায়। কিভাবে হনুমানকে বলা হয়েছিল উত্তর থেকে বিরাট একটি লিঙ্গাম ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু যখন তিনি অনেক বেশি সময় নেন তখন সীতা আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। নিজে নিজের হাত দিয়ে লিঙ্গামের মাধ্যমে শিবের পূজা করতে থাকেন। আমার চারদিকে এরকম অনেক গল্প ও কণ্ঠ। কারণ, সারা ভারতের এক এক অংশের মানুষ ফেরি সার্ভিস ব্যবহার করতো। এত মানুষের মধ্যে সব সময়ই একটি ছোট্ট শিশুকে স্বাগত জানানো হতো। কেউ না কেউ আমার সঙ্গে ইচ্ছে করেই কথা বলতে শুরু করতেন। তাদের জীবনের গল্প শোনাতেন আমাকে। কেন তীর্থ যাত্রা করছেন তার কারণও ব্যাখ্যা করতেন আমার কাছে।
এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যেতে থাকে। আমাকে অনেক অনেক জিনিস শিক্ষা দিতে থাকে আমার স্কুল, শিক্ষকরা ও আহমেদ জালালুদ্দিন। তাই বলে যেসব ওই বোট ও তার আরোহীরা তারা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এভাবেই সমুদ্রের ঢেউ আর বালুরাশি, হাসি আর তামাশার মধ্য দিয়ে কেটে যায় দিন। তারপর একদিন ঘটল দুর্ঘটনা।
ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আঘাত করল বঙ্গোপসাগরে। নভেম্বর এবং মে মাস এক্ষেত্রে বেশি ভয়ানক। যে রাতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছিল এখনও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমার স্মরণ আছে। দিনের পর দিন বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। এরপর তা এক দমকা হাওয়ার রূপ গ্রহণ করে। সেই ঘূর্ণি বাতাসের গোঙানি আর সাঁ সাঁ শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। সে রাতে অনেক গাছ এমনকি সামনে যা কিছু পড়েছিল তার সবই উপড়ে ফেলেছিল বাতাস। শিগগিরই শুরু হয় মওসুমি বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। আগে থেকেই আমাদেরকে বাড়ির ভিতর রাখা হয়েছিল। কয়েক দিন পর্যন্ত ছিল না বিদ্যুৎ। বেঁচে থাকার উপকরণের একটি ছিল চেরাগ। সেই ভয়াবহ ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে, যেখানে বাতাস ক্রমাগত উন্মত্ত রূপ নিচ্ছে, তখন বাইরে বৃষ্টির ঝাপটা আছড়ে পড়ছে। আমরা সবাই সে রাতে জড়াজড়ি করে রইলাম। কোনমতে পার করে দিলাম রাত। খোলা সমুদ্রের প্রতি আমার চিন্তা বার বারই ফিরে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে কেউ কি সাগরে আটকা পড়ে আছেন? যদি কারও মা কাছে না থাকেন তাহলে এমন একটি ঝড়ের রাতে কেমন অনুভূতি হতে পারে?
পরের দিন সকালে ঝড় পড়ে গেল। আমরা চারদিকে চোখ মেলে দেখলাম এক ধ্বংসলীলা। গাছ, বাড়িঘর সব উপড়ে পড়ে আছে।
বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সবকিছু। পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে রাস্তা। কোথাও পথ ঢাকা পড়েছে ধ্বংসস্তূপে। ওই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ মাইলের ওপরে। কিন্তু সবার কাছে সবচেয়ে খারাপ যে খবরটি ছিল তা হলো তা যেন আমাদের হৃদয়ে আঘাত করলো। সেই খবরটি হলো, আমাদের বোটটি বাতাসে নিয়ে গেছে। এখন আমি যখন ওই দিনটির কথা স্মরণ করি, ঝড় কেটে যাওয়ার আশায় আমরা যখন সময় পার করতে থাকি তখন আমি বুঝতে পারি আমার পিতা হয়তো রাতের আগেই আন্দাজ করে থাকবেন যে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এ নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগ যাতে আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটায় সে জন্য তিনি ছেলেমেয়েদের শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সকালের আলোয় যখন তার মুখের দিকে তাকালাম দেখতে পেলাম তার চোখের চারদিকে হতাশা দাগ কেটে গেছে। আমি আমার ভাবনাগুলোকে একত্র করার চেষ্টা করলাম। আমাদের ফেরি বোটটি হারিয়েছি এজন্য মনে মনে ভয়াবহভাবে মরাকান্না করলাম। আমার মনে হলো, আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি ওই বোট। এখন তা অচিন্তনীয়ভাবে আমার কাছ তেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
এই সঙ্কটে আমার পিতা একরকম উদাসীন হয়ে পড়লেন। ইত্যবসরে আরেকটি বোট আনা হলো এবং বাবার ব্যবসা ফের শুরু হলো। আবার আসতে শুরু করলেন তীর্থযাত্রী ও পর্যটক। তীর্থযাত্রীতে ভরে উঠতে থাকলো মন্দির ও মসজিদ। বাজারে ভিড় বাড়তে থাকলো নারী ও পুরুষের। আবার শুরু হলো কেনাবেচা।
ঘূর্ণিঝড় ও ঝড় বার বারই আমাদের আঘাত করেছে। এমনকি এর মধ্যেই আমি ঘুমানো শিখেছি। এর অনেক বছর পরে ১৯৬৪ সালে তখন আমি রামেশ্বরমে থাকি না, আবার একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে। এবার এই ঘূর্ণিঝড় ধানুশকোড়ির ভূ-ভাগ থেকে বিরাট একটি অংশ বিলীন হয়ে গেল। যখন ওই ভূ-ভাগ পানিতে গ্রাস করে তখন পামবান ব্রিজের ওপর ছিল একটি রেলগাড়ি, তার ভিতর ছিলেন অনেক তীর্থযাত্রী। ওই ঘটনায় ওই এলাকার ভূ-প্রকৃতি পাল্টে দেয়। ধানুশকোড়ি হয়ে ওঠে এক ভৌতিক শহর। আর কোনদিন এ শহর তার পুরনো চেহারা ফিরে পায়নি। এমনকি আজও, ১৯৬৪ সালের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ভবনের অবশিষ্ট অংশ।
আবার এক ঝড়ে আমাদের পরের বোটটিও হারালেন আমার পিতা। আবারও তাকে ব্যবসা নতুন করে শুরু করতে হলো। আমি তখন অনেক দূরে থাকায় বাবাকে বাস্তবে তেমন কোন সহায়তা করতে পারিনি। যখন আমি স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যাল (এসএলভি) রকেটের আকৃতি দেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, অথবা যখন পৃথ্বি ও অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র উড্ডয়নের ক্ষণ গণনা শুরু হতো কিন্তু উড্ডয়নে ব্যাঘাত ঘটতো এবং থুম্বা ও চণ্ডিপুরে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র উড্ডয়ন কেন্দ্রে বৃষ্টি নেমে আসতো তখন ঝড়ের পরে আমার পিতার মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। এটাই প্রকৃতির শক্তি। এর অর্থ হলো সমুদ্রের পাশাপাশি বেঁচে থাকা ও সমুদ্র থেকে জীবিকা আরোহণ। যখন জানতে পারলাম এমন একটি শক্তি ও ক্ষমতা আছে যা আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চোখের নিমিষে শেষ করে দিতে পারে, তখন মনে হলো সমস্যার মোকাবিলা করে বেঁচে থাকাই একমাত্র পথ এবং জীবন গঠনের পন্থা।
আট বছর বয়সেই কর্মী
প্রতিদিন সকালে ইংরেজি ও তামিল ভাষার সংবাদপত্রের বিশাল বিশাল স্তূপ দেয়া হয় আমাকে। বিদেশ সফরের সময় আমি ভারতের খবর পড়তে পছন্দ করি। আমি অনলাইনে গিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের খবর ও সম্পাদকীয় পড়ি। এখন বিস্ময়করভাবে আমার আঙ্গুলের এক ক্লিকের মধ্যে তথ্যভাণ্ডার। যেহেতু আমি প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত তাই প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা আমাকে অতোটা বিস্মিত করা উচিত নয়। কিন্তু যখন আমি আমার এখনকার জীবনধারাকে ৭০ বছর আগের দক্ষিণ ভারতের একটি ছোট্ট শহরের জীবনধারার সঙ্গে তুলনা করি, তখন যে পার্থক্য ধরা পড়ে তাতে আমি বিহ্বল হয়ে যাই।
আমার জন্ম ১৯৩১ সালে। যখন আমার বয়স ৮ বছর তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বৃটেন। ভারতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতও বৃটিশ ঔপনিবেশ হওয়ায় এ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ভারত রেকর্ড সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে। যা হোক, এতে জীবনযাত্রায় প্রথমদিকে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি, বিশেষ করে আমরা দেশের দক্ষিণাংশে ছিলাম বলে। আগেই বলেছি, রামেশ্বরম ১৯৪০-এর দশকে ছিল একটি নীরব ছোট্ট শহর। তীর্থযাত্রীদের আগমনে তা সজীব হয়ে ওঠে। সেখানে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই ছিলেন বাণিজ্যিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এ শহরটি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। যদিও সেখানে ছিল একটি মসজিদ ও একটি গির্জা। অধিবাসীরা খুব শান্তিতে বসবাস করতেন। সেখানে বাইরের দুনিয়ার খবর জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল খবরের কাগজ। সংবাদপত্র যে এজেন্সি বিতরণ করতো তা চালাতেন আমার কাজিন সামসুদ্দিন। জালালুদ্দিনের পাশাপাশি তিনিও ছিলেন আমার শৈশবকালের জীবনে বড় এক প্রভাব। পড়তে ও লিখতে পারলেও সামসুদ্দিন খুব বেশি সফল করেননি, তিনি উচ্চশিক্ষিতও ছিলেন না।
আমার প্রতি তার ছিল অসীম স্নেহ। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করতেন। সেই উৎসাহ আমার জীবনে নির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে। আমি সুযোগ পাওয়া বা প্রদর্শনের আগেই তারা আমার গভীর চিন্তা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। আমার কাছে তারা ছিলেন বড়, যিনি তার নিত্যদিনের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসার ফাঁকে সংকীর্ণ সুযোগে বিশাল দুনিয়াকে দেখতে পেতেন। রামেশ্বরমে সংবাদপত্র বিতরণের একমাত্র এজেন্সি ছিল সামসুদ্দিনের। তখন শহরে ছিলেন হাজারখানেক শিক্ষিত মানুষ। তিনি তাদের সবার কাছে খবরের কাগজ পৌঁছে দিতেন। খবরের কাগজে স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর থাকতো। এই খবরগুলো সবার গুরুত্ব দিয়ে পড়া ও আলোচনা করা উচিত। এছাড়া ছিল সম্মুখ সমরের খবর, থাকতো হিটলার ও নাৎসি সেনাবাহিনীর খবর। থাকতো নিঃস্বাদ খবরও। যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, স্বর্ণ-রুপার দামের খবর। এসব কাগজের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল তখন তামিল ভাষার ‘দিনমনি’। এই পত্রিকাগুলো যেভাবে রামেশ্বরমে পৌঁছেছিল তা ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। সকালে রেলগাড়িতে করে আসতো তা। রাখা হতো রামেশ্বরম রেল স্টেশনে। সেখান থেকে সংগ্রহ করতে হতো এবং তা সব গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে হতো। এটাই ছিল সামসুদ্দিনের ব্যবসা এবং তিনি এটাকে কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা করেছেন। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তুঙ্গে ওঠে তখন আমরা আর বাকি বিশ্ব থেকে আলাদা থাকতে পারলাম না।
এটা আমার জীবনে বেশ প্রভাব ফেলল। সংবাদপত্র বিতরণ করা হতো নতুন এক অদ্ভুত উপায়ে।
বৃটিশ সরকার বেশ কিছু পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রেশনে কড়াকড়ি আরোপ করে। এখন জরুরি অবস্থা দিলে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। আমাদের পরিবার ছিল অনেক বড়। আমরা এ জটিলতাটি খুব ভালভাসে বুঝতে পারলাম। খাদ্য, পোশাক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহে দেখা দিল জটিলতা। চাচারাও তাদের পরিবার নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। এজন্য আমাদের পরিবারে ছিল ৫টি ছেলে ও মেয়ে শিশু। সবার মুখে খাবার, পরনে কাপড় ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আমার মা ও দাদী। যেহেতু যুদ্ধ শুরুর জটিলতা আমাদের আক্রান্ত করতে শুরু করল, তখন সামসুদ্দিন একটি প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন। এতে আমি বিস্মিত ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম ভীষণভাবে। ততদিনে রামেশ্বরম স্টেশনে ট্রেন থামা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আমাদের পত্রিকার কি হবে? কিভাবে পত্রিকা সংগ্রহ করে তা শহরের সব লোকের মাঝে, যারা তাদের নিত্যদিনের খবরের খোরাকের জন্য সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাদের কাছে সেই পত্রিকা বিতরণ করা হবে? এক্ষেত্রে একটি পথ বের করে ফেললেন সামসুদ্দিন। তা হলো, পত্রিকাগুলো বড় বড় বান্ডিলে প্রস্তুত রাখা হবে। ট্রেনটি যখন রামেশ্বরম-ধানুশকোড়ির মধ্যে চলাচল করবে এবং প্লাটফরমে এসে আস্তে চলবে তখন পত্রিকার ওই বান্ডিলগুলো ছুড়ে দেয়া হবে। আমি সেখানেই আসছি। সামসুদ্দিন আমাকে একটি মজার কাজ প্রস্তাব করলেন। বলছেন, ধীরগতির ওই চলন্ত ট্রেন থেকে যখন পত্রিকার বান্ডিলগুলো ছুড়ে দেয়া হবে তা ধরতে হবে আমাকে। তারপর তা আমাকেই নিয়ে যেতে হবে শহরে বিতরণের জন্য।
আমার আনন্দ সীমা ছাড়িয়ে গেল। তখন আমার বয়স মাত্র আট বছর। কিন্তু বাড়ির জন্য কিছু খরচ যোগাড় করার জন্য অর্থপূর্ণ একটি উপায়ে আমি পত্রিকাগুলো বিতরণ করতে যাচ্ছি। পিতা-মাতা খেতে বসলেই তাদের প্লেটের খাবার আমাদের সবার মাঝে ভাগ করে দিতেন। এতে এক সময় লক্ষ্য করি যে, তাদের প্লেটের খাবার দিন দিন কমে আসছে। তাদের প্লেটে অবশিষ্ট তেমন কিছুই আর থাকছে না। নিয়ম ছিল সব সময়ই ছেলেমেয়েরা আগে খাবে। আমরা কখনও ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছি এমনটা মনে করতে পারছি না। অবশ্যই আমাদের পুষ্টির জন্য পিতামাতা বিরাট এক ত্যাগ করে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় আমি সামসুদ্দিনের প্রস্তাবে উৎফুল্ল হয়ে রাজি হয়ে যাই।
যাহোক, আমার নতুন এই কাজটি আমার নিয়মিত রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হলো। আগের মতোই স্কুল ও পড়াশোনা চলতে লাগলো আমার। পড়াশোনার বাইরে পত্রিকা বিতরণের কাজটি করে যেতে হলো। আমার ভাইবোন ও চাচাতো, মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে আমিই কম বয়সে গণিতের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। এক্ষেত্রে আমার জন্য আমাদের গণিতের শিক্ষককে প্রাইভেট শিক্ষা দেয়ার বন্দোবস্ত করলেন। তবে শিক্ষকের একটি শর্ত ছিল। তা হলো তার কাছে আমিসহ অন্য চারজন পড়বো। তিনি শর্তে বললেন, আমাদেরকে সকালে গোসল সেরে তার বাড়িতে যেতে হবে। এক বছর এভাবে প্রাইভেট শিক্ষা নিতে থাকলাম। কিন্তু আমি সন্ধ্যা নেমে এলেও কাজ করতে থাকি। এতে আমার মায়ের মুখে মলিনতা দেখা দেয়। তিনিও তো আমার আগে ঘুম থেকে ওঠেন। আমাকে গোসল করিয়ে দেন। আমাকে খাবার খাওয়ান। তারপর শিক্ষকের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেখানে আমি এক ঘণ্টা পড়াশোনা করি। ফিরে আসি ভোর ৫টায়। ততক্ষণে আমার পিতা রেডি হয়ে বসে থাকতেন। অপেক্ষা করতেন আমাকে কাছেই একটি আরবি স্কুলে নিয়ে যেতে। সেখানেই আমি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা শিখি।
আমার মা ও বোন
অনেক বছর আগে আমি একটি কবিতা লিখেছি। তার নাম ‘মাই মাদার’ বা আমার মা। এটা শুরু করেছিলাম এভাবে:
সমুদ্রের তরঙ্গ, স্বর্ণালী বালুকা, তীর্থযাত্রীর বিশ্বাস,
রামেশ্বরম মসজিদ সড়ক, সব মিলে একাকার,
আমার মা!
আমার বেড়ে ওঠার বছরগুলোর কথা আমি এখনও স্মরণ করতে পারি। এগুলো এতবেশি নস্টালজিয়া যে, তা আমার রামেশ্বরমের স্মৃতিজুড়ে আছে। তখন আমার জগতে ছিলেন দু’জন ব্যক্তি। তারা হলেন আমার পিতা ও মাতা। এই দু’জন মানুষ রয়েছেন আমার জগতের কেন্দ্রস্থলে। আমাদের পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত। আমার পিতা ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। এর বাইরে তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। আমার মা আশিয়াম্মা এমন একটি পরিবার থেকে এসেছেন, যে পরিবারের একজনকে কিছুদিন আগে বৃটিশরা ‘বাহাদুর’ খেতাব দিয়েছিল। মা ছিলেন অতি শান্ত। মাটির মানুষ। ধার্মিক নারী। তিনি আমার পিতার মতো ছিলেন নিবেদিত মুসলমান। মা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। প্রার্থনায় গিয়ে কান্না করতেন। এসব স্মৃতি আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিত ও শান্তিপ্রিয়। তাকে বড় একটি সংসার দেখাশোনা করতে হতো। এতেই তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যেত। আমাদের পরিবারের সদস্য বলতে আমি ও আমার ভাইবোন, আমাদের আত্মীয়রা, যেমন দাদা-দাদী, চাচারা। আমরা সবাই বাস করতাম একই বাড়িতে। তাই সব সময় সবাইকে সবকিছু দেয়া সম্ভব হতো না। সবাইকে কোন কিছু পর্যাপ্ত দেয়া যেত না। আমাদেরকে প্রয়োজনের তুলনায় দেয়া হতো কমই। আবার ব্যবসা থেকে যে আয় হতো তা ছিল একই রকম। আমাদের ছিল নারকেলের বাগান ও ফেরি ব্যবসা। তাতে কোনমতে আমাদের খরচ উঠে যেতে। কখনও বিলাসিতার বালাই ছিল না।
এ অবস্থায় মা আমার বাবার প্রতি রইলেন একজন আদর্শ জীবনসঙ্গিনীর মতো। তিনি মিতব্যয়িতার বিষয় বুঝতে পারতেন। যতদূর সম্ভব খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। আমরা যেমন জীবনযাপন করছি তা নিয়ে তাকে কখনও রাগতে দেখিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি।
আমার প্রথম পরামর্শক:
আহমেদ জালালুদ্দিন
আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে, সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে খুব কম উল্লেখ করার মতো মানুষকেই কাছে পেয়েছি। তারাই মাঝেমধ্যে পাল্টে দিয়েছেন আমার জীবনধারা। এসব পরামর্শদাতার প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ ও তাদেরকে স্মরণে রাখবো আরও আরও বেশি। এখন যদি আমার কাছে বিশ্বের সবটুকু সময় থাকতো তাহলে আমি কি করতাম তা জানি: যেসব মানুষ আমার জীবনকে এভাবে পাল্টে দিয়েছেন তাদের স্মরণ করে
সময় কাটাতাম। তারা হলেন সূর্যের মতো। সূর্য যেমন ভূপৃষ্ঠকে উষ্ণ করে, তার কারণে বাতাস প্রবাহিত হয়, তারা আমার কাছে সেরকম। আমার জীবনে এমন একজন হলেন আহমেদ জালালুদ্দিন।
যখন আমি ব্যর্থ হই
আমার জীবন দীর্ঘ। এতে রয়েছে নানা ঘটনা। সফলতার সর্বোচ্চ অবস্থা আমি দেখেছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের জাতির জন্য যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা সেক্ষেত্রে আমি যৌথভাবে অবদান রেখেছি। দেশের সর্বোচ্চ পদের অধিকারীও হয়েছি আমি। পিছনে তাকালে অনেক সফলতা দেখতে পাই। এর কিছুটা নিজে নিজে অর্জন করেছি। কিছু আছে দলগতভাবে অর্জন। আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারা সবাই ভীষণ মেধাবী। এখনও আমি বিশ্বাস করি যে, যদি কোন ক্ষেত্রে তিক্ত ব্যর্থতা না থাকে তাহলে কোন ব্যক্তি সফলতার আশা করতে পারে না। আমি একটি মুদ্রার দু’পিঠই দেখেছি। আমি জীবনের কঠিন সময় থেকে শিক্ষা নিয়েছি। এসব শিক্ষা মূল্যবান ও স্মরণীয়। কারণ, এগুলো আমাকে আমার জটিল কাজগুলো বা জটিল সময়ে সহায়তা করেছে। আমার জীবনে প্রথমেই এমন যে ঘটনাটি ঘটেছে তা ঘটেছে এমআইটির এরোনটিকস-এর ছাত্র থাকা অবস্থায়। সেখানে আমার ডিজাইন টিচার ছিলেন প্রফেসর শ্রীনিবাসন। একই সঙ্গে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধানও ছিলেন। আমরা একদিন চারজন ছাত্রের একটি করে দল গঠন করলাম। আমাদের দল নিম্নমানের হামলাকারী বিমানের ডিজাইন করলো। এরোডিনামিকের ডিজাইনের চার্জে বা দায়িত্বে ছিলাম আমি। এ নিয়ে অনেক সপ্তাহ ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার টিম-মেটরা সবাই তৈরি করলো অন্য অংশগুলো। যেমন প্রপালসন, কাঠামো, কন্ট্রোল ও ইন্সট্রুমেন্টেশন। যেহেতু আমাদের কোর্সের কাজ ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই আমরা অনেক সময় বসে বসে আমাদের আইডিয়া ও গবেষণা নিয়ে আলোচনা করি। প্রজেক্টটি করে শিক্ষককে তাক লাগিয়ে দেবো এমন অভিপ্রায় ছিল সবার মধ্যে। তারা সবাই চাইছিল অগ্রগতি। কয়েক দিন পরে প্রফেসর শ্রীনিবাসন আমাদের ডিজাইন দেখতে চাইলেন, যা আমি তৈরি করেছি। আমি যখন তা তাকে দেখালাম গুরুত্ব দিয়ে তিনি সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি কি রায় দেন তা জানতে আমি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তার সামনে যে পেপারটি বিছানো সেদিকে তাকিয়ে তার আইভ্রু কিভাবে কুঞ্চিত হলো তা এখনও আমার মনে আছে। তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বললেন। তার কথায় আমি হতচেতন হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, কালাম এটা ততটা সুন্দর হয়নি। তিনি আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলতে লাগলেন- তোমার কাছ থেকে আমি এর চেয়ে ভাল কিছু প্রত্যাশা করেছি। এটা নিরানন্দ এক কাজ। এতে আমি হতাশ। আমি হতাশ এ কারণে যে, তোমার মতো একজন মেধাবী এমন কাজ করতে পারে।
আমি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে রইলাম বাকশক্তিহীন। যে কোন শ্রেণীতে আমি ছিলাম সব সময় স্টার ছাত্র। কোনকিছুর জন্য কোনদিন শিক্ষকের বকুনি খেতে হয়নি। প্রফেসরের কথায় যতটা বিব্রত ও লজ্জিত হলাম তা আমার জীবনে নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। এর একটুও আমি সহ্য করতে পারলাম না। প্রফেসর কিছু সময় মাথা দোলালেন এবং আমাকে বললেন, পুরো ডিজাইনটি আমাকে নতুন করে করতে হবে। প্রথমে স্কেচ থেকে শুরু করতে হবে। আমার সমস্ত ধারণা কাজে লাগাতে হবে চিন্তা করতে। লজ্জাবনত মুখে আমি তার কথা মেনে নিলাম। এরপর তিনি আরও একটি খারাপ খবর শোনালেন। আমাকে শুধু এ ডিজাইনটি নতুন করে করতে হবে তা-ই নয়, আমাকে তা শেষ করতে হবে তিন দিনের মধ্যে। তিনি বললেন, আজ শুক্রবার বিকাল ইয়ং ম্যান। সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে আমি একটি ত্রুটিবিহীন ডিজাইন দেখতে চাই। তুমি যদি তা করতে ব্যর্থ হও তাহলে তোমার স্কলারশিপ বন্ধ করে দেয়া হবে।
এবার আমি পুরোপুরি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম। কলেজে পড়াশোনার জন্য আমার একমাত্র ভরসা স্কলারশিপ। এটা কেড়ে নেয়া হলে আমাকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। আমার উচ্চাশা, পিতামাতার স্বপ্ন, আমার বোন ও জালালুদ্দিন আমার চোখের ওপর দিয়ে যেন ফ্লাশ দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এটা অবিশ্বাস্য যে, আমার প্রফেসরের কয়েকটি কথা আমার ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করেছে। তিনি এসব কথা না বললে আমার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়তো বিবর্ণ।
আমি সঠিক পথে কাজ করে যেতে থাকি। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এমন দৃঢ় সংকল্প আমার মনে। আমি রাতের খাবার বাদ করে দিলাম। সারা রাত ড্রয়িং বোর্ডের ওপর মুখ উপুড় করে বসে রইলাম। আগে থেকে আমার মাথায় যেসব ধারণা ভাসছিল তা এবার এক করলাম। তারপর একটি আকৃতি কল্পনা করলাম, যা নিয়ে আমি কাজ করতে পারি। পরের দিন সকালেও পেশাদার একজন ব্যক্তির মতো আমি কাজ করে যেতে থাকি। নাস্তা ও সজীবতার জন্য সামান্য বিরতি নিই। এরপর আবার ফিরি কাজে। রোববার সন্ধ্যা নাগাদ আমার কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এটা একটি রুচিশীল, পরিচ্ছন্ন ডিজাইন। এ ডিজাইনটি নিয়ে আমি গর্বিত। যখন আমি এটিতে চূড়ান্ত টাচ দিচ্ছি আমার তখন মনে হলো রুমের ভিতর কেউ একজন এসেছেন। তিনি আর কেউ নন, সেই প্রফেসর। তখনও তার পরনে টেনিসের সাদা পোশাক। তিনি ক্লাব থেকে ফিরেছেন। তিনি এ রুমে ঢুকে কখন থেকে আমাকে অনুসরণ করছেন তা আমি জানি না। এবার যখন তার চোখে চোখ পড়লো তিনি তখন এগিয়ে এলেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি আমার কাজ দেখলেন। কড়াভাবে দেখলেন। তারপর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং হাসলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি স্নেহ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, আমি যখন আগের ডিজাইন বাতিল করেছি, জানি তোমাকে আমি অনেক বড় চাপে ফেলে দিয়েছি। অসম্ভাব্য একটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি, তার মধ্যে তুমি যে কাজ করেছো তা অসাধারণ। তোমার শিক্ষক হিসেবে আমি তোমাকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলাম যাতে তুমি তোমার আসল শক্তি দেখাতে পারো। দু’দিন পর তার এই কথাগুলো আমার কানে সুমধুর সংগীতের মতো মনে হলো।
(এপিজে আবদুল কালাম-এর ‘মাই জার্নি : ট্রান্সফরমিং ড্রিমস ইনটু অ্যাকশনস’ বইয়ের অংশবিশেষের অনুবাদ করেছেন
মোহাম্মদ আবুল হোসেন)
এ দ্বীপ দু’টির মধ্যে দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। যখন তিনি এ ধারণাটি মাথায় আনলেন এবং আমরা একটি বোট বানালাম- সেই সময়টার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে এখনও। রামেশ্বরম যেহেতু প্রাচীন, তাই এটি তীর্থযাত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, রাম যখন সীতাকে উদ্ধার অভিযানে ছিলেন তখন তিনি এখানে থেমেছিলেন এবং লংকা পর্যন্ত সেতু নির্মাণ করেছিলেন। রামেশ্বরমে যে মন্দিরটি আছে তা উৎসর্গ করা হয়েছে শিবকে। এখানে একটি ঘরে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছেন সীতা। রামায়ণের কিছু কিছু সংস্করণে বলা হয়েছে, লংকা থেকে অযোধ্যায় ফেরার পথে রাম, লক্ষণ ও সীতা এখানে থেমেছিলেন শিবের কাছে প্রার্থনা করতে। যেসব তীর্থযাত্রী এখানে আসতেন তাদের অনেকেই আমাদের শহরের। এখান থেকে ধানুশকোড়ি যেতেন। এখানে সাগরসঙ্গমে স্নান করা এক পবিত্র কর্ম। এই সঙ্গম হলো বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মিলনস্থল। ধানুশকোড়িতে এখন সড়কপথে যাওয়া যায়। তীর্থযাত্রীদের সেখানে নিয়ে যায় ভ্যান।
শৈশবের কথায় ফিরে আসি। যখন আমি শিশু সে সময়ে এ দ্বীপে যাওয়ার উত্তম উপায় ছিল ফেরি। আমার পিতার উপার্জন ভাল হতো না। তাই তিনি বিকল্প চিন্তা করতে লাগলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ফেরি নিয়ে ব্যবসা করবেন। তিনি একটি বোট নির্মাণ শুরু করলেন। প্রথম দিকে এ কাজ তিনি একাই শুরু করলেন। বোটটি নির্মাণ করা আমাদের জন্য খুব দরকারি ছিল। সমুদ্র উপকূলে চলাফেরার জন্য তা প্রয়োজন। কাঠ এবং কিছু ধাতব পদার্থের সংমিশ্রণে একটি বোটে জীবন সঞ্চারিত হতে দেখতে দেখতে সম্ভবত প্রকৌশল দুনিয়ার ধারণা প্রথম আমার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বোট বানানোর জন্য কাঠ সংগ্রহ করা হলো। আহমেদ জালালুদ্দিন নামে এক কাজিন আমার পিতাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। যেখানে বোটটি নতুন চেহারা পাচ্ছে প্রতিদিন আমি সেখানে যাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। এক রকম অধৈর্য হয়ে পড়তাম। বিশাল বিশাল কাঠ কেটে কেটে একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি দেয়া হচ্ছিল। তা শুকানো হচ্ছিল। এরপর তা মসৃণ করা হচ্ছিল। তারপর তা একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া দেয়া হয়। আগুন জ্বালিয়ে কাঠ থেকে বাকল ও অপ্রয়োজনীয় অংশ পুড়িয়ে আলাদা করা হতো। এরপর তা দিয়ে বানানো হতো গলুই। আস্তে আস্তে বোটের নিচের অংশ বানানো হলো। তারপর পাশের অংশ। এরপর শুরু হতো গলুই বানানো। এ ঘটনাগুলো ঘটেছে আমার চোখের সামনে। এর অনেক বছর পরে আমি কাজ করতে গিয়ে জানতে পারি কিভাবে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে হয়। প্রকৌশল জগতের এ মাইলফলকের মূলে রয়েছে জটিল গণিত ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা। কিন্তু ওই যে বোট, যা উপকূলে ফিরে আসতো। তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যেত। জেলেদের নিয়ে যেত। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতো- কে বলবে ওই সময় এই বোটই তখনকার জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? এই বোট তৈরির প্রক্রিয়া আমার জীবনে অন্যভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এর মাধ্যমে আমার জীবনে পবির্তন এনেছেন আহমেদ জালালুদ্দিন। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। আমার ভেতর জানার জন্য যে আকাঙক্ষা এবং আমার যে প্রশ্ন ছিল তার প্রতি তিনি ছিলেন নমনীয়। সব সময়ই তিনি আমার কথা শুনতেন ধৈর্য সহকারে। তিনিই আমাকে উপদেশ দিতেন। তিনি ইংরেজি পড়তে ও লিখতে পারতেন। বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কার, সাহিত্য ও ওষুধ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতেন। রামেশ্বরমের রাস্তায় যখনই তার সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করতাম অথবা আমরা বোটে বসে আলোচনা করতাম, তখনই মনে মনে আইডিয়া ও উচ্চাকাঙক্ষা পোষণ করতে শুরু করি। বোটের ব্যবসা বেশ সফল হয়েছিল। এ ব্যবসা চালাতে আমার পিতা নিয়োগ দিয়েছিলেন কিছু লোক। তীর্থযাত্রীদের বিভিন্ন গ্রুপ তাদের ব্যবহার করতো ধানুশকোড়ি পৌঁছাতে। এমনও অনেক দিন গেছে, যখন আমি জনতার ভিড়ের মধ্যে পিছলে পড়ে যেতাম এবং বোটে মানুষের ভিড়ে বসে পড়তাম। বোট রামেশ্বরমে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতো। আমি শুনেছি রামের গল্প এবং তিনি তার সেনাবাহিনী বানরদের সহায়তায় কিভাবে লংকা পর্যন্ত ব্রিজ নির্মাণ করেছিলেন। কিভাবে তিনি সীতাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং রামেশ্বরমে ফের থেমেছিলেন, যাতে রাবণকে হত্যার অনুশোচনা করা যায়। কিভাবে হনুমানকে বলা হয়েছিল উত্তর থেকে বিরাট একটি লিঙ্গাম ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু যখন তিনি অনেক বেশি সময় নেন তখন সীতা আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। নিজে নিজের হাত দিয়ে লিঙ্গামের মাধ্যমে শিবের পূজা করতে থাকেন। আমার চারদিকে এরকম অনেক গল্প ও কণ্ঠ। কারণ, সারা ভারতের এক এক অংশের মানুষ ফেরি সার্ভিস ব্যবহার করতো। এত মানুষের মধ্যে সব সময়ই একটি ছোট্ট শিশুকে স্বাগত জানানো হতো। কেউ না কেউ আমার সঙ্গে ইচ্ছে করেই কথা বলতে শুরু করতেন। তাদের জীবনের গল্প শোনাতেন আমাকে। কেন তীর্থ যাত্রা করছেন তার কারণও ব্যাখ্যা করতেন আমার কাছে।
এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যেতে থাকে। আমাকে অনেক অনেক জিনিস শিক্ষা দিতে থাকে আমার স্কুল, শিক্ষকরা ও আহমেদ জালালুদ্দিন। তাই বলে যেসব ওই বোট ও তার আরোহীরা তারা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এভাবেই সমুদ্রের ঢেউ আর বালুরাশি, হাসি আর তামাশার মধ্য দিয়ে কেটে যায় দিন। তারপর একদিন ঘটল দুর্ঘটনা।
ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আঘাত করল বঙ্গোপসাগরে। নভেম্বর এবং মে মাস এক্ষেত্রে বেশি ভয়ানক। যে রাতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছিল এখনও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমার স্মরণ আছে। দিনের পর দিন বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। এরপর তা এক দমকা হাওয়ার রূপ গ্রহণ করে। সেই ঘূর্ণি বাতাসের গোঙানি আর সাঁ সাঁ শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। সে রাতে অনেক গাছ এমনকি সামনে যা কিছু পড়েছিল তার সবই উপড়ে ফেলেছিল বাতাস। শিগগিরই শুরু হয় মওসুমি বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। আগে থেকেই আমাদেরকে বাড়ির ভিতর রাখা হয়েছিল। কয়েক দিন পর্যন্ত ছিল না বিদ্যুৎ। বেঁচে থাকার উপকরণের একটি ছিল চেরাগ। সেই ভয়াবহ ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে, যেখানে বাতাস ক্রমাগত উন্মত্ত রূপ নিচ্ছে, তখন বাইরে বৃষ্টির ঝাপটা আছড়ে পড়ছে। আমরা সবাই সে রাতে জড়াজড়ি করে রইলাম। কোনমতে পার করে দিলাম রাত। খোলা সমুদ্রের প্রতি আমার চিন্তা বার বারই ফিরে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে কেউ কি সাগরে আটকা পড়ে আছেন? যদি কারও মা কাছে না থাকেন তাহলে এমন একটি ঝড়ের রাতে কেমন অনুভূতি হতে পারে?
পরের দিন সকালে ঝড় পড়ে গেল। আমরা চারদিকে চোখ মেলে দেখলাম এক ধ্বংসলীলা। গাছ, বাড়িঘর সব উপড়ে পড়ে আছে।
বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সবকিছু। পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে রাস্তা। কোথাও পথ ঢাকা পড়েছে ধ্বংসস্তূপে। ওই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ মাইলের ওপরে। কিন্তু সবার কাছে সবচেয়ে খারাপ যে খবরটি ছিল তা হলো তা যেন আমাদের হৃদয়ে আঘাত করলো। সেই খবরটি হলো, আমাদের বোটটি বাতাসে নিয়ে গেছে। এখন আমি যখন ওই দিনটির কথা স্মরণ করি, ঝড় কেটে যাওয়ার আশায় আমরা যখন সময় পার করতে থাকি তখন আমি বুঝতে পারি আমার পিতা হয়তো রাতের আগেই আন্দাজ করে থাকবেন যে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এ নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগ যাতে আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটায় সে জন্য তিনি ছেলেমেয়েদের শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সকালের আলোয় যখন তার মুখের দিকে তাকালাম দেখতে পেলাম তার চোখের চারদিকে হতাশা দাগ কেটে গেছে। আমি আমার ভাবনাগুলোকে একত্র করার চেষ্টা করলাম। আমাদের ফেরি বোটটি হারিয়েছি এজন্য মনে মনে ভয়াবহভাবে মরাকান্না করলাম। আমার মনে হলো, আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি ওই বোট। এখন তা অচিন্তনীয়ভাবে আমার কাছ তেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
এই সঙ্কটে আমার পিতা একরকম উদাসীন হয়ে পড়লেন। ইত্যবসরে আরেকটি বোট আনা হলো এবং বাবার ব্যবসা ফের শুরু হলো। আবার আসতে শুরু করলেন তীর্থযাত্রী ও পর্যটক। তীর্থযাত্রীতে ভরে উঠতে থাকলো মন্দির ও মসজিদ। বাজারে ভিড় বাড়তে থাকলো নারী ও পুরুষের। আবার শুরু হলো কেনাবেচা।
ঘূর্ণিঝড় ও ঝড় বার বারই আমাদের আঘাত করেছে। এমনকি এর মধ্যেই আমি ঘুমানো শিখেছি। এর অনেক বছর পরে ১৯৬৪ সালে তখন আমি রামেশ্বরমে থাকি না, আবার একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে। এবার এই ঘূর্ণিঝড় ধানুশকোড়ির ভূ-ভাগ থেকে বিরাট একটি অংশ বিলীন হয়ে গেল। যখন ওই ভূ-ভাগ পানিতে গ্রাস করে তখন পামবান ব্রিজের ওপর ছিল একটি রেলগাড়ি, তার ভিতর ছিলেন অনেক তীর্থযাত্রী। ওই ঘটনায় ওই এলাকার ভূ-প্রকৃতি পাল্টে দেয়। ধানুশকোড়ি হয়ে ওঠে এক ভৌতিক শহর। আর কোনদিন এ শহর তার পুরনো চেহারা ফিরে পায়নি। এমনকি আজও, ১৯৬৪ সালের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ভবনের অবশিষ্ট অংশ।
আবার এক ঝড়ে আমাদের পরের বোটটিও হারালেন আমার পিতা। আবারও তাকে ব্যবসা নতুন করে শুরু করতে হলো। আমি তখন অনেক দূরে থাকায় বাবাকে বাস্তবে তেমন কোন সহায়তা করতে পারিনি। যখন আমি স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যাল (এসএলভি) রকেটের আকৃতি দেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, অথবা যখন পৃথ্বি ও অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র উড্ডয়নের ক্ষণ গণনা শুরু হতো কিন্তু উড্ডয়নে ব্যাঘাত ঘটতো এবং থুম্বা ও চণ্ডিপুরে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র উড্ডয়ন কেন্দ্রে বৃষ্টি নেমে আসতো তখন ঝড়ের পরে আমার পিতার মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। এটাই প্রকৃতির শক্তি। এর অর্থ হলো সমুদ্রের পাশাপাশি বেঁচে থাকা ও সমুদ্র থেকে জীবিকা আরোহণ। যখন জানতে পারলাম এমন একটি শক্তি ও ক্ষমতা আছে যা আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চোখের নিমিষে শেষ করে দিতে পারে, তখন মনে হলো সমস্যার মোকাবিলা করে বেঁচে থাকাই একমাত্র পথ এবং জীবন গঠনের পন্থা।
আট বছর বয়সেই কর্মী
প্রতিদিন সকালে ইংরেজি ও তামিল ভাষার সংবাদপত্রের বিশাল বিশাল স্তূপ দেয়া হয় আমাকে। বিদেশ সফরের সময় আমি ভারতের খবর পড়তে পছন্দ করি। আমি অনলাইনে গিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের খবর ও সম্পাদকীয় পড়ি। এখন বিস্ময়করভাবে আমার আঙ্গুলের এক ক্লিকের মধ্যে তথ্যভাণ্ডার। যেহেতু আমি প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত তাই প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা আমাকে অতোটা বিস্মিত করা উচিত নয়। কিন্তু যখন আমি আমার এখনকার জীবনধারাকে ৭০ বছর আগের দক্ষিণ ভারতের একটি ছোট্ট শহরের জীবনধারার সঙ্গে তুলনা করি, তখন যে পার্থক্য ধরা পড়ে তাতে আমি বিহ্বল হয়ে যাই।
আমার জন্ম ১৯৩১ সালে। যখন আমার বয়স ৮ বছর তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বৃটেন। ভারতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতও বৃটিশ ঔপনিবেশ হওয়ায় এ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ভারত রেকর্ড সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে। যা হোক, এতে জীবনযাত্রায় প্রথমদিকে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি, বিশেষ করে আমরা দেশের দক্ষিণাংশে ছিলাম বলে। আগেই বলেছি, রামেশ্বরম ১৯৪০-এর দশকে ছিল একটি নীরব ছোট্ট শহর। তীর্থযাত্রীদের আগমনে তা সজীব হয়ে ওঠে। সেখানে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই ছিলেন বাণিজ্যিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এ শহরটি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। যদিও সেখানে ছিল একটি মসজিদ ও একটি গির্জা। অধিবাসীরা খুব শান্তিতে বসবাস করতেন। সেখানে বাইরের দুনিয়ার খবর জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল খবরের কাগজ। সংবাদপত্র যে এজেন্সি বিতরণ করতো তা চালাতেন আমার কাজিন সামসুদ্দিন। জালালুদ্দিনের পাশাপাশি তিনিও ছিলেন আমার শৈশবকালের জীবনে বড় এক প্রভাব। পড়তে ও লিখতে পারলেও সামসুদ্দিন খুব বেশি সফল করেননি, তিনি উচ্চশিক্ষিতও ছিলেন না।
আমার প্রতি তার ছিল অসীম স্নেহ। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করতেন। সেই উৎসাহ আমার জীবনে নির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে। আমি সুযোগ পাওয়া বা প্রদর্শনের আগেই তারা আমার গভীর চিন্তা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। আমার কাছে তারা ছিলেন বড়, যিনি তার নিত্যদিনের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসার ফাঁকে সংকীর্ণ সুযোগে বিশাল দুনিয়াকে দেখতে পেতেন। রামেশ্বরমে সংবাদপত্র বিতরণের একমাত্র এজেন্সি ছিল সামসুদ্দিনের। তখন শহরে ছিলেন হাজারখানেক শিক্ষিত মানুষ। তিনি তাদের সবার কাছে খবরের কাগজ পৌঁছে দিতেন। খবরের কাগজে স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর থাকতো। এই খবরগুলো সবার গুরুত্ব দিয়ে পড়া ও আলোচনা করা উচিত। এছাড়া ছিল সম্মুখ সমরের খবর, থাকতো হিটলার ও নাৎসি সেনাবাহিনীর খবর। থাকতো নিঃস্বাদ খবরও। যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, স্বর্ণ-রুপার দামের খবর। এসব কাগজের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল তখন তামিল ভাষার ‘দিনমনি’। এই পত্রিকাগুলো যেভাবে রামেশ্বরমে পৌঁছেছিল তা ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। সকালে রেলগাড়িতে করে আসতো তা। রাখা হতো রামেশ্বরম রেল স্টেশনে। সেখান থেকে সংগ্রহ করতে হতো এবং তা সব গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে হতো। এটাই ছিল সামসুদ্দিনের ব্যবসা এবং তিনি এটাকে কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা করেছেন। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তুঙ্গে ওঠে তখন আমরা আর বাকি বিশ্ব থেকে আলাদা থাকতে পারলাম না।
এটা আমার জীবনে বেশ প্রভাব ফেলল। সংবাদপত্র বিতরণ করা হতো নতুন এক অদ্ভুত উপায়ে।
বৃটিশ সরকার বেশ কিছু পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রেশনে কড়াকড়ি আরোপ করে। এখন জরুরি অবস্থা দিলে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। আমাদের পরিবার ছিল অনেক বড়। আমরা এ জটিলতাটি খুব ভালভাসে বুঝতে পারলাম। খাদ্য, পোশাক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহে দেখা দিল জটিলতা। চাচারাও তাদের পরিবার নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। এজন্য আমাদের পরিবারে ছিল ৫টি ছেলে ও মেয়ে শিশু। সবার মুখে খাবার, পরনে কাপড় ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আমার মা ও দাদী। যেহেতু যুদ্ধ শুরুর জটিলতা আমাদের আক্রান্ত করতে শুরু করল, তখন সামসুদ্দিন একটি প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন। এতে আমি বিস্মিত ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম ভীষণভাবে। ততদিনে রামেশ্বরম স্টেশনে ট্রেন থামা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আমাদের পত্রিকার কি হবে? কিভাবে পত্রিকা সংগ্রহ করে তা শহরের সব লোকের মাঝে, যারা তাদের নিত্যদিনের খবরের খোরাকের জন্য সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাদের কাছে সেই পত্রিকা বিতরণ করা হবে? এক্ষেত্রে একটি পথ বের করে ফেললেন সামসুদ্দিন। তা হলো, পত্রিকাগুলো বড় বড় বান্ডিলে প্রস্তুত রাখা হবে। ট্রেনটি যখন রামেশ্বরম-ধানুশকোড়ির মধ্যে চলাচল করবে এবং প্লাটফরমে এসে আস্তে চলবে তখন পত্রিকার ওই বান্ডিলগুলো ছুড়ে দেয়া হবে। আমি সেখানেই আসছি। সামসুদ্দিন আমাকে একটি মজার কাজ প্রস্তাব করলেন। বলছেন, ধীরগতির ওই চলন্ত ট্রেন থেকে যখন পত্রিকার বান্ডিলগুলো ছুড়ে দেয়া হবে তা ধরতে হবে আমাকে। তারপর তা আমাকেই নিয়ে যেতে হবে শহরে বিতরণের জন্য।
আমার আনন্দ সীমা ছাড়িয়ে গেল। তখন আমার বয়স মাত্র আট বছর। কিন্তু বাড়ির জন্য কিছু খরচ যোগাড় করার জন্য অর্থপূর্ণ একটি উপায়ে আমি পত্রিকাগুলো বিতরণ করতে যাচ্ছি। পিতা-মাতা খেতে বসলেই তাদের প্লেটের খাবার আমাদের সবার মাঝে ভাগ করে দিতেন। এতে এক সময় লক্ষ্য করি যে, তাদের প্লেটের খাবার দিন দিন কমে আসছে। তাদের প্লেটে অবশিষ্ট তেমন কিছুই আর থাকছে না। নিয়ম ছিল সব সময়ই ছেলেমেয়েরা আগে খাবে। আমরা কখনও ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছি এমনটা মনে করতে পারছি না। অবশ্যই আমাদের পুষ্টির জন্য পিতামাতা বিরাট এক ত্যাগ করে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় আমি সামসুদ্দিনের প্রস্তাবে উৎফুল্ল হয়ে রাজি হয়ে যাই।
যাহোক, আমার নতুন এই কাজটি আমার নিয়মিত রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হলো। আগের মতোই স্কুল ও পড়াশোনা চলতে লাগলো আমার। পড়াশোনার বাইরে পত্রিকা বিতরণের কাজটি করে যেতে হলো। আমার ভাইবোন ও চাচাতো, মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে আমিই কম বয়সে গণিতের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। এক্ষেত্রে আমার জন্য আমাদের গণিতের শিক্ষককে প্রাইভেট শিক্ষা দেয়ার বন্দোবস্ত করলেন। তবে শিক্ষকের একটি শর্ত ছিল। তা হলো তার কাছে আমিসহ অন্য চারজন পড়বো। তিনি শর্তে বললেন, আমাদেরকে সকালে গোসল সেরে তার বাড়িতে যেতে হবে। এক বছর এভাবে প্রাইভেট শিক্ষা নিতে থাকলাম। কিন্তু আমি সন্ধ্যা নেমে এলেও কাজ করতে থাকি। এতে আমার মায়ের মুখে মলিনতা দেখা দেয়। তিনিও তো আমার আগে ঘুম থেকে ওঠেন। আমাকে গোসল করিয়ে দেন। আমাকে খাবার খাওয়ান। তারপর শিক্ষকের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেখানে আমি এক ঘণ্টা পড়াশোনা করি। ফিরে আসি ভোর ৫টায়। ততক্ষণে আমার পিতা রেডি হয়ে বসে থাকতেন। অপেক্ষা করতেন আমাকে কাছেই একটি আরবি স্কুলে নিয়ে যেতে। সেখানেই আমি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা শিখি।
আমার মা ও বোন
অনেক বছর আগে আমি একটি কবিতা লিখেছি। তার নাম ‘মাই মাদার’ বা আমার মা। এটা শুরু করেছিলাম এভাবে:
সমুদ্রের তরঙ্গ, স্বর্ণালী বালুকা, তীর্থযাত্রীর বিশ্বাস,
রামেশ্বরম মসজিদ সড়ক, সব মিলে একাকার,
আমার মা!
আমার বেড়ে ওঠার বছরগুলোর কথা আমি এখনও স্মরণ করতে পারি। এগুলো এতবেশি নস্টালজিয়া যে, তা আমার রামেশ্বরমের স্মৃতিজুড়ে আছে। তখন আমার জগতে ছিলেন দু’জন ব্যক্তি। তারা হলেন আমার পিতা ও মাতা। এই দু’জন মানুষ রয়েছেন আমার জগতের কেন্দ্রস্থলে। আমাদের পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত। আমার পিতা ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। এর বাইরে তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। আমার মা আশিয়াম্মা এমন একটি পরিবার থেকে এসেছেন, যে পরিবারের একজনকে কিছুদিন আগে বৃটিশরা ‘বাহাদুর’ খেতাব দিয়েছিল। মা ছিলেন অতি শান্ত। মাটির মানুষ। ধার্মিক নারী। তিনি আমার পিতার মতো ছিলেন নিবেদিত মুসলমান। মা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। প্রার্থনায় গিয়ে কান্না করতেন। এসব স্মৃতি আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিত ও শান্তিপ্রিয়। তাকে বড় একটি সংসার দেখাশোনা করতে হতো। এতেই তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যেত। আমাদের পরিবারের সদস্য বলতে আমি ও আমার ভাইবোন, আমাদের আত্মীয়রা, যেমন দাদা-দাদী, চাচারা। আমরা সবাই বাস করতাম একই বাড়িতে। তাই সব সময় সবাইকে সবকিছু দেয়া সম্ভব হতো না। সবাইকে কোন কিছু পর্যাপ্ত দেয়া যেত না। আমাদেরকে প্রয়োজনের তুলনায় দেয়া হতো কমই। আবার ব্যবসা থেকে যে আয় হতো তা ছিল একই রকম। আমাদের ছিল নারকেলের বাগান ও ফেরি ব্যবসা। তাতে কোনমতে আমাদের খরচ উঠে যেতে। কখনও বিলাসিতার বালাই ছিল না।
এ অবস্থায় মা আমার বাবার প্রতি রইলেন একজন আদর্শ জীবনসঙ্গিনীর মতো। তিনি মিতব্যয়িতার বিষয় বুঝতে পারতেন। যতদূর সম্ভব খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। আমরা যেমন জীবনযাপন করছি তা নিয়ে তাকে কখনও রাগতে দেখিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি।
আমার প্রথম পরামর্শক:
আহমেদ জালালুদ্দিন
আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে, সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে খুব কম উল্লেখ করার মতো মানুষকেই কাছে পেয়েছি। তারাই মাঝেমধ্যে পাল্টে দিয়েছেন আমার জীবনধারা। এসব পরামর্শদাতার প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ ও তাদেরকে স্মরণে রাখবো আরও আরও বেশি। এখন যদি আমার কাছে বিশ্বের সবটুকু সময় থাকতো তাহলে আমি কি করতাম তা জানি: যেসব মানুষ আমার জীবনকে এভাবে পাল্টে দিয়েছেন তাদের স্মরণ করে
সময় কাটাতাম। তারা হলেন সূর্যের মতো। সূর্য যেমন ভূপৃষ্ঠকে উষ্ণ করে, তার কারণে বাতাস প্রবাহিত হয়, তারা আমার কাছে সেরকম। আমার জীবনে এমন একজন হলেন আহমেদ জালালুদ্দিন।
যখন আমি ব্যর্থ হই
আমার জীবন দীর্ঘ। এতে রয়েছে নানা ঘটনা। সফলতার সর্বোচ্চ অবস্থা আমি দেখেছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের জাতির জন্য যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা সেক্ষেত্রে আমি যৌথভাবে অবদান রেখেছি। দেশের সর্বোচ্চ পদের অধিকারীও হয়েছি আমি। পিছনে তাকালে অনেক সফলতা দেখতে পাই। এর কিছুটা নিজে নিজে অর্জন করেছি। কিছু আছে দলগতভাবে অর্জন। আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারা সবাই ভীষণ মেধাবী। এখনও আমি বিশ্বাস করি যে, যদি কোন ক্ষেত্রে তিক্ত ব্যর্থতা না থাকে তাহলে কোন ব্যক্তি সফলতার আশা করতে পারে না। আমি একটি মুদ্রার দু’পিঠই দেখেছি। আমি জীবনের কঠিন সময় থেকে শিক্ষা নিয়েছি। এসব শিক্ষা মূল্যবান ও স্মরণীয়। কারণ, এগুলো আমাকে আমার জটিল কাজগুলো বা জটিল সময়ে সহায়তা করেছে। আমার জীবনে প্রথমেই এমন যে ঘটনাটি ঘটেছে তা ঘটেছে এমআইটির এরোনটিকস-এর ছাত্র থাকা অবস্থায়। সেখানে আমার ডিজাইন টিচার ছিলেন প্রফেসর শ্রীনিবাসন। একই সঙ্গে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধানও ছিলেন। আমরা একদিন চারজন ছাত্রের একটি করে দল গঠন করলাম। আমাদের দল নিম্নমানের হামলাকারী বিমানের ডিজাইন করলো। এরোডিনামিকের ডিজাইনের চার্জে বা দায়িত্বে ছিলাম আমি। এ নিয়ে অনেক সপ্তাহ ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার টিম-মেটরা সবাই তৈরি করলো অন্য অংশগুলো। যেমন প্রপালসন, কাঠামো, কন্ট্রোল ও ইন্সট্রুমেন্টেশন। যেহেতু আমাদের কোর্সের কাজ ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই আমরা অনেক সময় বসে বসে আমাদের আইডিয়া ও গবেষণা নিয়ে আলোচনা করি। প্রজেক্টটি করে শিক্ষককে তাক লাগিয়ে দেবো এমন অভিপ্রায় ছিল সবার মধ্যে। তারা সবাই চাইছিল অগ্রগতি। কয়েক দিন পরে প্রফেসর শ্রীনিবাসন আমাদের ডিজাইন দেখতে চাইলেন, যা আমি তৈরি করেছি। আমি যখন তা তাকে দেখালাম গুরুত্ব দিয়ে তিনি সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি কি রায় দেন তা জানতে আমি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তার সামনে যে পেপারটি বিছানো সেদিকে তাকিয়ে তার আইভ্রু কিভাবে কুঞ্চিত হলো তা এখনও আমার মনে আছে। তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বললেন। তার কথায় আমি হতচেতন হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, কালাম এটা ততটা সুন্দর হয়নি। তিনি আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলতে লাগলেন- তোমার কাছ থেকে আমি এর চেয়ে ভাল কিছু প্রত্যাশা করেছি। এটা নিরানন্দ এক কাজ। এতে আমি হতাশ। আমি হতাশ এ কারণে যে, তোমার মতো একজন মেধাবী এমন কাজ করতে পারে।
আমি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে রইলাম বাকশক্তিহীন। যে কোন শ্রেণীতে আমি ছিলাম সব সময় স্টার ছাত্র। কোনকিছুর জন্য কোনদিন শিক্ষকের বকুনি খেতে হয়নি। প্রফেসরের কথায় যতটা বিব্রত ও লজ্জিত হলাম তা আমার জীবনে নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। এর একটুও আমি সহ্য করতে পারলাম না। প্রফেসর কিছু সময় মাথা দোলালেন এবং আমাকে বললেন, পুরো ডিজাইনটি আমাকে নতুন করে করতে হবে। প্রথমে স্কেচ থেকে শুরু করতে হবে। আমার সমস্ত ধারণা কাজে লাগাতে হবে চিন্তা করতে। লজ্জাবনত মুখে আমি তার কথা মেনে নিলাম। এরপর তিনি আরও একটি খারাপ খবর শোনালেন। আমাকে শুধু এ ডিজাইনটি নতুন করে করতে হবে তা-ই নয়, আমাকে তা শেষ করতে হবে তিন দিনের মধ্যে। তিনি বললেন, আজ শুক্রবার বিকাল ইয়ং ম্যান। সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে আমি একটি ত্রুটিবিহীন ডিজাইন দেখতে চাই। তুমি যদি তা করতে ব্যর্থ হও তাহলে তোমার স্কলারশিপ বন্ধ করে দেয়া হবে।
এবার আমি পুরোপুরি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম। কলেজে পড়াশোনার জন্য আমার একমাত্র ভরসা স্কলারশিপ। এটা কেড়ে নেয়া হলে আমাকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। আমার উচ্চাশা, পিতামাতার স্বপ্ন, আমার বোন ও জালালুদ্দিন আমার চোখের ওপর দিয়ে যেন ফ্লাশ দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এটা অবিশ্বাস্য যে, আমার প্রফেসরের কয়েকটি কথা আমার ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করেছে। তিনি এসব কথা না বললে আমার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়তো বিবর্ণ।
আমি সঠিক পথে কাজ করে যেতে থাকি। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এমন দৃঢ় সংকল্প আমার মনে। আমি রাতের খাবার বাদ করে দিলাম। সারা রাত ড্রয়িং বোর্ডের ওপর মুখ উপুড় করে বসে রইলাম। আগে থেকে আমার মাথায় যেসব ধারণা ভাসছিল তা এবার এক করলাম। তারপর একটি আকৃতি কল্পনা করলাম, যা নিয়ে আমি কাজ করতে পারি। পরের দিন সকালেও পেশাদার একজন ব্যক্তির মতো আমি কাজ করে যেতে থাকি। নাস্তা ও সজীবতার জন্য সামান্য বিরতি নিই। এরপর আবার ফিরি কাজে। রোববার সন্ধ্যা নাগাদ আমার কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এটা একটি রুচিশীল, পরিচ্ছন্ন ডিজাইন। এ ডিজাইনটি নিয়ে আমি গর্বিত। যখন আমি এটিতে চূড়ান্ত টাচ দিচ্ছি আমার তখন মনে হলো রুমের ভিতর কেউ একজন এসেছেন। তিনি আর কেউ নন, সেই প্রফেসর। তখনও তার পরনে টেনিসের সাদা পোশাক। তিনি ক্লাব থেকে ফিরেছেন। তিনি এ রুমে ঢুকে কখন থেকে আমাকে অনুসরণ করছেন তা আমি জানি না। এবার যখন তার চোখে চোখ পড়লো তিনি তখন এগিয়ে এলেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি আমার কাজ দেখলেন। কড়াভাবে দেখলেন। তারপর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং হাসলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি স্নেহ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, আমি যখন আগের ডিজাইন বাতিল করেছি, জানি তোমাকে আমি অনেক বড় চাপে ফেলে দিয়েছি। অসম্ভাব্য একটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি, তার মধ্যে তুমি যে কাজ করেছো তা অসাধারণ। তোমার শিক্ষক হিসেবে আমি তোমাকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলাম যাতে তুমি তোমার আসল শক্তি দেখাতে পারো। দু’দিন পর তার এই কথাগুলো আমার কানে সুমধুর সংগীতের মতো মনে হলো।
(এপিজে আবদুল কালাম-এর ‘মাই জার্নি : ট্রান্সফরমিং ড্রিমস ইনটু অ্যাকশনস’ বইয়ের অংশবিশেষের অনুবাদ করেছেন
মোহাম্মদ আবুল হোসেন)