টঙ্গী: শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের অধীন গাজীপুর জেলার সকল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান দেখভাল করার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পদির্শন অধিদপ্তরের একটি মাত্র অফিস টঙ্গীতে অবস্থিত। প্রতিদিনই এই অফিসে শ্রমিকেরা তাদের মজুরী আদায়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান করেন। এই অফিসের সামনে শ্রমিকদের কান্না নিত্য দিনের চিত্র।
সোমবার(১৬ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় এই দৃশ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, টঙ্গী, গাজীপুর, শ্রীপুর কালিয়াকৈর গাজীপুর সদর, কাপাসিয়া ও কালিগঞ্জ মিলে যতগুলো শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে সব গুলো নিয়ন্ত্রন সংস্থা টঙ্গী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রম বিক্রি করে যারা জীবন যাপন করেন তাদের মধ্যে যারা প্রতিষ্ঠানের নিকট শ্রমের মূল্য পাওনা থাকেন সে সকল পাওনা উদ্ধারের জন্য এই প্রতিষ্ঠানে আসেন ভুক্তভোগীরা। ফলে প্রতিদিনই টঙ্গীর এই অফিসের সামনে কমবেশী অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হয়ে থাকে। তাই অফিসের গেটের বাইরে বা ভেতরে নি¤œআয়ের ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না যেন নিত্য দিনের চিত্র।
জানা যায়, শিল্পরাজধানী খ্যাত গাজীপুর জেলার একটি মহানগর ও ৫টি উপজেলা রয়েছে। টঙ্গী ও কোনাবাড়ি বিসিক সহ বেশ কয়েকটি শিল্লাঞ্চল রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের অধীন। বিশাল আয়তনের বিরাট সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রন সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর টঙ্গী। এই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান রয়েছেন। উপ-মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর টঙ্গী। এরপর সহকারী মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার তিনজন কর্মকর্তা রয়েছেন। গাজীপুর জেলাকে ১৪টি জোনে ভাগ করে প্রতিটি জোনে দুই জন করে ২৮জন পরিদর্শক কাজ করছেন। পরিদর্শন কালে উপ-মহাপরিদর্শক আহমেদ বেলালকে অফিসে পাওয়া যায়নি।
সহকারী মহাপরিদর্শক(সাধারণ) মো: মোতালেব মিয়া বলেন, বেলাল সাহেব বিদেশী ডেলিগেটদের সাথে ফ্যাক্টরী ভিজিটে রয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের অধীন মোট দুই হাজার ১২৭টি কারখানা রয়েছে বলে জানান তিনি। কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা আদায়ের কয়টি অভিযোগ নিস্পত্তি হয়েছে ও কতগুলো মামলা রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেননি তিনি। তবে পরিসখ্যান দিবেন বলে জানিয়েছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর টঙ্গী অফিসে প্রবেশর সাথে সাথেই দেখা গেলো বেশ কিছু শ্রমিক গেটের ভেতরে ভবনে প্রবেশের রাস্তায় বসে আছেন। বসে থাকার কারণ হিসেবে তারা জানান, গাজীপুর মহানগরের গাছা থানাধীন কলমেশ^র এলাকায় অবস্থিত রাজবাড়ি গার্মেন্ট এর শ্রমিক তারা। অনেক শ্রমিকের পক্ষে ৩৩জন শ্রমিক এসেছেন দুই মাসের বেতন ভাতা ও ওভারটাইমের মজুরী আদায়ের দাবিতে তারা কলকারখানা অধিদপ্তরে এসেছেন। মালিকপক্ষ একাধিকবার তারিখ দিয়েও বকেয়া পরিশোধ করছেন না। খেয়ে না খেয়ে তারা নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছেন। এখানে বিচার না পেলে তারা থানায় যাবেন মামলা করতে এমনটাও জানিয়েছেন শ্রমিকেরা।
রাজবাড়ি গার্মেন্ট এর হেলপার সমৃদ্ধি রানী সেন জানায়, তার স্বামীর নাম জয়ধর চন্দ্র সেন। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার কুতুবপুর গ্রামে। তিন মাস ধরে তিনি বেতন পাচ্ছেন না। মালিক বেতন দিচ্ছেন না শুধু তারিখ দিচ্ছেন। তাই তিনি সকলের সাথে এসেছেন পাওনা আদায়ের জন্য।
মৌলভী বাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার সাজগাও গ্রামের আইয়ুব আলীর মেয়ে আছিয়া জানান, তিনি অপারেটর পদে চাকুরী করেন। মালিক তিন মাসের বেতন ও ওভারটাইম দিচ্ছেন না। খেয়ে না খেয়ে জীবপন যাপন করছেন তার পরিবার।
একই ধরণের অভিযোগ অপারেটর মিলি রানী, রোকসানা, সাবিনা আক্তার, রুপচান চন্দ্র রায় সহ ৩৩জনের।
এ বিষয়ে রাজবাড়ি গার্মেন্ট এর মালিক রাজু মিয়া কালের কন্ঠকে বলেন, এক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। আগামী বিশ তারিখ দিব বলার পরও তারা কাজ ছেড়ে চলে গেছে।
এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর টঙ্গীর সহকারী মহাপরিদর্শক মো: মোতালেব কন্ঠকে বলেন, রাজবাড়ি গার্মেন্ট এর মালিকের নামে আগেও দুটি মামলা রয়েছে। আজকের ঘটনায় তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ২২ অক্টোবর তিনি এই অফিসে আসবেন। তখন শ্রমিকেরাও থাকবে। উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে সমস্যা সমাধান করা হবে।
টঙ্গী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গেটের সামনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দোকানী জানায়, প্রতিদিন এখানে শত শত শ্রমিক আসেন। মিছিল নিয়ে তারা গেটের বাইরে আসতেই গেট বন্ধ হয়ে যায়। তারপর সারাদিন বসে থেকে সন্ধ্যায় চলে যায় তারা। আবার মাঝে মধ্যে কেউ কেউ রাস্তার পাশে রাতে শুয়েও থাকেন। এসব ক্ষুধার্ত শ্রমিক টাকার অভাবে কিছু কিনেও খেতে পারেন না। তাই অনেকে এমনিতেই তাদের চা রুটি কলা খাওয়ায়।
কারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাজীপুর জেলায় ছোট বড় মিলে কমপক্ষে ছয় হাজারের বেশী কারখানা রয়েছে। অনেক কারখানার কাগজপত্র নেই। কিছু কারখানার কিছু কাগজপত্র রয়েছে। সাবকন্ট্রাকে কাজ করা কারখানার সংখ্যাও অনেক। এরা কাগজপত্রের ধার ধারে না। তবে শ্রমিক অসন্তোষ হলে শ্রমিকেরা এখানে আসেন। আন্দোলন করেন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এই প্রতিষ্ঠান ছাড়াও শিল্পপুলিশ এবং থানা পুলিশ রয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনতো আছেই। তারপরও শ্রমিক অসেন্তাষ দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ দেখভাল করার লোকজন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। তদারকিতে তদন্ত থাকলে ও সাথে সাথে ব্যবস্থা নিলে শ্রমিক অসন্তোষ অনেক কমে যেতো।
শ্রমিকদের দাবি, তাদের মজুরী প্রদানের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঢিলেঢালা ভাব। সহজে মজুরী দিতে চায় না মালিকপক্ষ। কারো কাছে বিচারও দেয়া যায় না। কারখানায় উচ্চবাচ্য করলে মালিকপক্ষের লোকজন হামলা করে। রাস্তায় গেলে পুলিশ ধরে। থানায় গেলে মামলা নেয় না। তাই আমাদের দাবী দাওয়া আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত।
শ্রমিকদের হয়রানীমূলক মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীদের মধ্যে একজন গাজীপুর বারের সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট জাকির হোসেন। এ্যাডভোকেট জাকির বলেন, মালিপক্ষ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই মিথ্যা মামলা দেয়। কারখানা ভাংচূর সংক্রান্ত মামলাই বেশী। শ্রমিকেরা যখন না খেয়ে আন্দোলন করেন তখন কারখানা মালিকেরা মামলা দেয় আর শ্রমিকেরা জেলে যায়। পুলিশ ধরে থানায় এনে মামলা দেয়। তিনি বলেন, অনেক মামলা করছি যার কোন ফি নেই নি। কারণ শ্রমিকের পেটে ভাত নেই ফি দিবে কোথা থেকে। এই আইনজীবী আরো বলেন, ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের জেলে না পুঁড়ে তাদের মজুরী ঠিকমত দিয়ে দিলে শ্রমিক অসন্তোষ কমে যেতো।