বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে শনির আছর পড়েছে বর্তমান আওয়ামী লুটেরা সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার শুরুর দিকেই। এর পরিণতিতে আজ সমগ্র অর্থনীতি ভয়াবহ নৈরাজ্যকর অবস্থায় পড়ে গেছে।
আজ গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে শনির আছর পড়েছে বর্তমান আওয়ামী লুটেরা সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার শুরুর দিকেই। এর পরিণতিতে আজ সমগ্র অর্থনীতি ভয়াবহ নৈরাজ্যকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রতিটি প্রধান সূচকের (মূল্যস্ফীতি, নিম্নমুখী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নিম্নমুখী রেমিটেন্স প্রবাহ, চলতি হিসাবের ঘাটতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার দরপতন) অবস্থান এতটাই শোচনীয়, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট আগের তুলনায় অনেকটা কমেছে। বিশ্ব অর্থনীতি গতি হারালেও থমকে যায়নি। অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে সফল হচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর ও বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কা কত দ্রুত উত্তরণ করতে শুরু করেছে। তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে ধার নেয়া কিছু ঋণ ইতোমধ্যে শোধও করেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছিল ৬৯.৮% শতাংশ, যা ২০২৩ এর আগস্টে নেমে হয়েছে মাত্র ২.১% শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের মাথায় ৬৭% শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে এনেছে শ্রীলঙ্কা। অথচ আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে তো পড়ছেই। যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে অস্বচ্ছ ও সমন্বয়হীনভাবে সমস্যাগুলোর সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পেয়েছেন ‘ডি’ গ্রেড, আর শ্রীলংকাকে দেউলিয়াত্ব ও ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি থেকে বের করে আনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পেয়েছেন ‘এ’ মাইনাস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবেই মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে নিমজ্জিত দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই আমাদের অর্থনীতি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। মূলত সরকারের পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বগ্রাসী লুটপাট আমাদের অর্থনীতির জীবনী শক্তিকে ক্রমেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার সর্বশেষ সংযোজন— কেবলমাত্র দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন নামে একটি বিশেষ গ্রুপ তথা ইচ্ছাকৃত লোন ডিফল্টারদের হাতে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে জনতা ব্যাংক ২২ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকে। একটি শিল্প গ্রুপ নামে বেনামে অস্তিত্বহীন ভুয়া কোম্পানির নামে কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৩০,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ গ্রুপটি সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার যোগ্য। এই গ্রুপটি ন্যূনতম এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। অথচ উচ্চ আদালত থেকে এ অর্থ লোপাটের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত করে দেয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশের যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুটপাট এখন সবচেয়ে সহজ’ বলে মন্তব্য করেছেন একজন অর্থনীতিবিদ। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে যারা বিদেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়েছে, একজন অর্থনীতিবিদ তাদেরকে ‘জাতীয় দুশমন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘তারা ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী।
তিনি আরো বলেন, সাধারণত কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলে বিদেশী ব্যাংকগুলো সেখানে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৩ টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনো বিদেশী ব্যাংক কি বাংলাদেশে এসেছে? উল্টা যে কয়েকটি বিদেশী ব্যাংক বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। একই ধরনের প্রোডাক্ট ও সেবা নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দেয়ার প্রতিযোগিতা করছে দেশের ৫২টি ব্যাংক। পরিসংখ্যান বলছে ৩০০ থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি (৬১ টি)। অর্থনীতিকে তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সৃষ্ট এই ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং নয় বরং জনগণের অর্থ লোপাটেই বেশি মনোযোগী।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ক্যাপিটাল পর্যাপ্ততা অনুপাত ১১.২, যেখানে ভারতের ১৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৬.৬ শতাংশ, এবং শ্রীলঙ্কার ১৫.৩ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাউন্ডনেসে ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০ তম, যা সাউথ এশিয়ান অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। অপরদিকে গ্লোবাল ইকোনমির গবেষণা মতে বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ১৩৬ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫ তম যা ২০০৯ সালের তুলনায় ২২ ধাপ পিছিয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫। সর্বশেষ বিএনপি সরকারের সময় যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সিগুলোর বাংলাদেশের ঋণমান হ্রাস ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং অ্যাজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে/নেতিবাচক সঙ্কেত দিয়েছে তাতে অর্থনীতি ‘রেড ফ্ল্যাগস’-এ উঠে এসেছে। গত মে মাসে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি ‘মুডিস’ বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বিএ ৩ থেকে নামিয়ে বি১- এ পুনর্নির্ধারণ করেছে। যেখানে প্রতিটি দেশ ক্রমান্বয়ে ভালো রেটিং পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেখানে গত এক যুগ পর এই মান কমানো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের ‘রেটিং আউটলুক’ হ্রাস করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তারা বাংলাদেশের জন্য ‘নেতিবাচক’ ঋণমান নির্ধারণ করেছে। সেইসাথে দেশের সার্বভৌম ঋণমান দীর্ঘ মেয়াদে ‘বিবি মাইনাস’ ও স্বল্প মেয়াদে ‘বি’ নিশ্চিত করেছে। সর্বশেষ ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘নেতিবাচক’ ঘোষণা করেছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিদেশী ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছে না। দেশের এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, অবৈধ সরকারের উন্নয়নের শ্লোগের নিচে চাপা পড়েছিল, যা এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ।
নজিরবিহীন তারল্য সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত : বেশ কিছুকাল থেকেই তারল্য সঙ্কটে পড়ে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে ৩ হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও যা দুই লাখ তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল। বিশেষ করে শরিয়াহ্ভিত্তিক পরিচালিত পাঁচটি ব্যাংক নিয়মিত সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়ে জরিমানায় পড়েছে। এ সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে। কিন্তু তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক আমানতকারির নিজস্ব আমানতের এমনকি এক লাখ টাকার চেকও অনার করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে লোন দেয়া সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে (ডেইলি স্টার : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। বিনিয়োগ ও ব্যবসার ওপর যার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।
কমছে এলসি খোলার হার, বাড়ছে মুল্যস্ফীতি : গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি এখন নজিরবিহীন মন্থরগতিতে চলছে। কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ কমছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। আমদানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য এ এক মহা চ্যালেঞ্জ। তার উপর রয়েছে স্বার্থান্বেষীদের সিন্ডিকেট। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। অনেকের সঞ্চয়ও শেষ। নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস তো আছেই বলে জানান তিনি।
লুটপাটের বেইল আউট : বেপরোয়া লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলো ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। মূলধন ঘাটতি পূরণে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জনগণের অর্থ ঢালছে সরকার। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ বছরে দেয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। কিন্তু এর পরও ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। এদিকে লুটপাটের শিকার বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করতে সরকারি ফান্ড ২৫ শতাংশের স্থলে ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখা নির্দেশ দিয়ে সরকার লুটপাটের আরও সুযোগ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সব ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে হয়, তা-ও ৬.৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ করেছে সরকার। এতে আমানতকারিদের অর্থের ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পেল। কিন্তু ভোটারবিহীন জনবিচ্ছিন্ন সরকারের তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ তাদেরতো জনগণের কাছে কোন জবাবদিহিতা নাই।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে : খেলাপি ঋণ গত ১০ বছরে তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, তা ২০২৩ সনের মার্চে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় ধরা হয়। এর বেশি হলেই তা ঝুঁকি। বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ ঝুঁকির চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। প্রলেপ দিয়ে নিয়মিত রাখা হয়েছে। এদিকে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ, অবলোপন করা ঋণ, অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা বিপুল অঙ্কের ঋণ, বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করাসহ আরো অনেক ঋণ রয়েছে যেগুলো খেলাপির যোগ্য কিন্তু খেলাপি করা হচ্ছে না, এসব ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ‘বর্তমানে খেলাপি ঋণ যা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে’।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র ২% অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। এমনকি আইন সংশোধন করে সরকার ঘনিষ্ঠ অলিগার্কদের একাধিকবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে। সঠিক পর্যালোচনা ও জাস্টিফিকেশন না থাকা সত্ত্বেও মনগড়াভাবে লোন রাইট অফ করা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাঘেষা লোকদের রক্ষা করার জন্য।
গত ১৫ বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা হয়েছে তার সামান্যই এসেছে গণমাধ্যমগুলোতে। তারপরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঐসব তথ্য দেখলে এই সেক্টরে বর্তমান আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায়।
ইসলামী ব্যাংকে ভয়ঙ্কর নভেম্বর : ২০২২ সালে আটটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। যার মধ্যে শুধুমাত্র ২০২২ সালের নভেম্বর মাসেই তুলে নেয়া হয় ২,৪৬০ কোটি টাকা, যা ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’ নামে পরিচিত। একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২,৩২০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামী ব্যাংক একটি নির্ভরতার প্রতীক ছিল। কিন্তু অলিগার্কদের হাতে পড়ে ব্যাংকটি আজ প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।
বেসিক ব্যাংকের চাঞ্চল্যকর আর্থিক কেলেঙ্কারি : বেসিক ব্যাংক একটি অন্যতম ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বহুল আলোচিত শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়ার পর ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় যোগসাজশে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লুট করে নেয় সে। দেশের আদালতে যার এখনো পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি।
জনতা ব্যাংক কেলেংকারি : সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম—বিধি ভংগ করে বহুল আলোচিত একটি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক, যা গত ২২ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে জনতা ব্যাংক দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। এর মাধ্যমে তারা কেবল এই গ্রুপটিকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯.৭৮ শতাংশ ঋণ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু কোনো একক গ্রাহককে মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেয়ার নিয়ম নেই।
ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি : মাত্র কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রক্ষমতার মধ্য থেকে সৃষ্ট ফারমার্স ব্যাংক এরই মধ্যে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে নতুনভাবে ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করে নতুন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে এই ব্যাংকের মতিঝিল ও গুলশান শাখা থেকে ২,৫০০ কোটি টাকার মতো লোপাট হয়েছে। উদ্যোক্তারাই এ ব্যাংককে খালি করে দিয়েছে। ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর নিজেই এর সাথে সরাসরি জড়িত বলে অনেকে মনে করেন। অথচ নিয়মনীতি ও নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে সরকার জনগণের অর্থ দিয়ে এই ব্যাংকটিকে বেইল আউট করছে।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি : আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ‘হলমার্ক’ রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ঐ সময়ে ব্যাংক খাতে অন্যতম বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ছিল হলমার্ক কেলেঙ্কারি, যা নিয়ে তখন বড় আলোচনা তৈরি হয়। এই টাকা আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক।
পি কে হালদার জালিয়াতি : এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা মিলে বিভিন্ন ব্যাংকিং এবং নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লুট করে শেখ হাসিনা সরকারের ছত্রছায়ায় নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। এ জন্য সরকারের উচ্চমহলে ১৫০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে মর্মে বর্তমানে বিদেশে কারাবন্দী পিকে হালদার সে দেশের এক অনুসন্ধানী সংস্থাকে (ইডি) জানিয়েছে মর্মে সম্প্রতি এক বিদেশী পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে (নর্থইস্ট নিউজ, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)|
অন্যান্য : এছাড়াও যেসব আর্থিক কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার ও তাদের অবৈধ সুযোগ ভোগীরা আর্থিক খাত থেকে অর্থ লুট করেছে তার মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৬২০ কোটি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এক হাজার ২০০ কোটি, এনন টেক্সটাইল ৫ হাজার ৫০৪ কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপে ২ হাজার ৭৬০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, এবি ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ইউনিপেটু কেলেংকারি, ডেসটিনি কেলেংকারি, এমটিএফই কেলেংকারি, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএসএল) কেলেংকারি অন্যতম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১০ কোটি টাকা চুরি : ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) চুরি সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ রিজার্ভ চুরিকে বিশ্বের অন্যতম ‘বিগেস্ট ব্যাংক হেইস্ট’ আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার চুরির ঘটনায় ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা’ রয়েছে এবং ‘ব্যাংক ডাকাতির হোতারা ব্যাংকের ভিতরেই আছে’ বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র এক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের তদন্ত প্রতিবেদন অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি। এতেই বোঝা যায় এই ডাকাতির সংগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এমন কেউ জড়িত যার নাম প্রকাশ হোক তারা তা চায়না। সম্প্রতি বোধগম্য কারণেই রিজার্ভ চুরির মামলার সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ ৭৪ বার পিছিয়েছে আদালত (মানবজমিন : ২০-০৯-২০২৩)। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই, সাগর-রুনী হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখ ১০১তম বার পিছিয়েছে এ ক’দিন আগেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুড়ে কাণ্ড : শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা ৯৬৩ কেজি সোনা যাচাই করে গুরুতর অনিয়ম পাওয়া গেছে। ছিল সোনার চাকতি, হয়ে গেছে মিশ্র ধাতু। ২২ ক্যারেট সোনা হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট (প্রথম আলো,১৭ জুলাই ২০১৮)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহজতর ও ত্বরান্বিত করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ঐতিহাসিক ‘রেগুলেটর’ এর ভূমিকা থেকে ‘ফ্যাসিলেটর’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী অলিগার্কদের কাছে দেশকে জিম্মি করে ফেলেছে, যা দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সম্প্রতি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালকদের মেয়াদ ৯ থেকে ১২ বছর করা হয়েছে। ঋণ খেলাপিরাও এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। আগে একটি গ্রুপের কোন প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পেত না। এখন এসব বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ তো কমবেই না, বরং ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হবে। আমানতকারিদের অর্থ আরও ঝুঁকিতে পড়বে (প্রথম আলো : ২ জুলাই, ২০২৩)। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাম্প্রতিক নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকের নিয়মিত বা চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের অবসরের পর একই ব্যাংকে পরিচালক হিসেবে যোগদানের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে দুর্নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো।
বর্তমান লুটেরা সরকার এবং পরিবারতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক গোষ্ঠী একে অপরের পৃষ্ঠপোষক ও পরিপূরক : বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমান সরকারের পরিবারতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক লুটেরা পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো ন্যাক্কারজনকভাবে ফুটে উঠেছে। সরকারের ক্ষমতা কাঠামোর সাথে পরিবারতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক লুটেরা পুঁজিপতিদের সম্পর্ক পারস্পরিক মিথোজীবিতার; একটি আরেকটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে; একে অপরের পরিপূরক। লুটেরা ব্যবসায়ীদের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহিতা, স্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা খুবই বিপজ্জনক। তাই রাষ্ট্রের অন্য সকল খাতের মত ব্যাংক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনকেও ধ্বংস করেছে তারা। কোন ব্যাংক লাইসেন্স পাবে কি না, টিকে থাকবে কি না তার অনেকখানিই নির্ভর করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আশীর্বাদ পাওয়া বা না পাওয়ার ওপর। অবাধ পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের পরিবারতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক চেহারাটি আজ স্পষ্ট। চারদিকে সাগর চুরি চলছে। মূলত অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংকিংখাতসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বেড়েছে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থপাচারও। বিষয়টি চরম উদ্বেগের হলেও এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কারণ, এই খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে বের করার দায়িত্ব যাদের তারাই এখন বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। সরিষায় ভূত। ফলে জাতীয় অর্থনীতি মহাপ্রলয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) : বর্তমান সরকার ও তাদের অবৈধ সুবিধাভোগীরা দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর তথ্যমতে, আমদানি ও রফতানি পণ্যমূল্যের মিসইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বাংলাদেশ। এভাবে নয় বছরেই দেশ থেকে ৭৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে।
* যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০১৫ সালে বলেছিলো, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। (বিবিসি ১৮ জুন ২০২২)
• ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের সিআইডি বরাতে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর হয়, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর বর্তমানে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫—১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হচ্ছে।
• অর্থপাচারের এই বিপুল স্রোত বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। জিএফআইয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণের অর্থ অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হয় তা দেশজ মোট গড় উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ।
• ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিজেএস সারা বিশ্বের অর্থ পাচারকারিদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে। এই তালিকায় বাংলাদেশের তিনটি কোম্পানি সহ ৮৯ জন বাংলাদেশি ও ১৪টি ঠিকানা প্রকাশিত হয়। এরা অবৈধ পন্থায় দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে জমা রেখেছেন।
• বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের গোপনে কেনা প্রপার্টির অর্থমূল্য এখন কম করে হলেও ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি (বণিক বার্তা : জানুয়ারি ১০, ২০২৩)। ‘দুবাইয়ে ১১ হাজার কো¤পানি বাংলাদেশীদের, ৬ মাসে বেড়েছে ৪৭% শতাংশ’ এই শিরোনামে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তায় আরও বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে।
বেগমপাড়া ও সেকেন্ড হোম : বর্তমান দূর্নীতিবাজ সরকারের সময় কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, দুবাই, আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং বেলারুশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট অনেকে জমি ও বাড়িঘর ক্রয় করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। এদিকে দেশের মানুষ আরো গরিব হচ্ছে। করোনার পর তিন কোটিরও বেশি লোক নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকার পাহাড় : সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা টাকার পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। দেশে যখন পাচার ঠেকানোর কথা বলা হচ্ছে, তখন নজিরবিহিনভাবে সুইস ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমেছে। জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৫৫% (যুগান্তর : ১৬-০৬-২০২২)।
সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের ভাই বাবর অর্থপাচারের মাস্টারমাইন্ড : সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অপরাধের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে হাইকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন (ডেইলি স্টার : জুন ১৪, ২০২২)। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন (বেয়াই) এই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির বিদেশে ২০০০ কোটি টাকা পাচার : পুলিশের সিআইডি দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমকে গ্রেফতার করেছে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি যদি ২০০০ কোটি টাকার মালিক হয় তাহলে সারাদেশে ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেদের’ চুরির স¤পদের পরিমাণ কত হতে পারে? এদের অনেকেই বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে বলে জানা যায় (কালের কণ্ঠ : ২১ আগস্ট ২০২০)।
রফতানির আড়ালে সম্প্রতি ১৪ শ’ কোটি টাকা বিদেশে পাচার : বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন পণ্যের অর্থ পরিশোধের আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের সত্যতা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা জমা দেওয়ার পর রহস্যজনকভাবে সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে ওই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে (সময়ের আলো : ২৬ আগস্ট, ২০২৩)। তৈরি পোশাক রফতানির আড়ালে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া, পানামা প্রভৃতি দেশে পাচারের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। একইসঙ্গে পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১০টি প্রতিষ্ঠানও শনাক্ত হয়েছে (মানবজমিন : ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
ইডিএফ এর আড়ালে ৭০০ কোটি ডলারের দুর্নীতি : রিজার্ভ থেকে অনিয়মিতভাবে নানা নামে ৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ফেলেছে সরকার, এর মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার বা সাত বিলিয়ন দিয়ে রফতানি উন্নয়ন তহবিল ইডিএফ গঠন করে ওই টাকা ঋণের নামে সহজ সুদে দলীয় আশীর্বাদপুষ্টদের দেয়া হয়েছে যা আর কখনো আদায় হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ইতোমধ্যেই রিজার্ভ থেকে নেয়া ডলার হিসাবে নেয়া ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার অনেকাংশই বিদেশে পাচার হয়েছে মর্মে অনেকে বিশ্বাস করেন।
অনেকেই বলছেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতের এক লাখের বেশি কোটি টাকার বৃহৎ অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
আর্থিক খাতসহ দেশে আইনের শাসন ও সার্বিক শৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জবাবদিহিতা। যেহেতু বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই, তাদের হাতে আমাদের এই দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা কোন কিছুই নিরাপদ নয়। তাই আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর কাছে উদাত্ত্ব আহবান আসুন বাংলাদেশে একটি সত্যিকার জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং দুঃসহ আওয়ামী সরকারের অবসান ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করি, তাহলেই ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যাংকিং সেক্টর তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।