শ্রীপুর গাজীপুর প্রতিনিধি: সংরক্ষিত বনভূমির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের করাত কল স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা গায়েই মাখছে না কেউ। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার, সংরক্ষিত বনের কোল ঘেঁষেই গড়ে তোলা হয়েছে করাত কল। শুধু তাই নয়, এসব করাত কলের জন্য নেওয়া হয়নি কোনো লাইসেন্স, নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও। আর এসব করাত কলে কাঠ জোগান দিতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে বন বিভাগের গাছ। তাতে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।
স্থানীয়রা বলছেন, বন ও পরিবেশ বিভাগের তদারকি ও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে শ্রীপুরের সংরক্ষিত গাজীপুর ইউনিয়ন, কাওরাইদ ইউনিয়ন, বরমী ইউনিয়ন, তেলিহাট, গোসিংগা ইউনিয়ন সহ বনের পাশে এভাবে লাইসেন্স ও ছাড়পত্রবিহীন অবৈধ করাত কল গড়ে উঠেছে। আর বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, গত কয়েকদিন উপজেলার বিট অফিসারের মাধ্যমে প্রত্যেকটি করাত কল মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে চিঠির মাধ্যমে বলা হয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন , অবৈধ করাত কল গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন বিভাগের চিঠি পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রায় অর্ধশতাধিক করাত কল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উপজেলার সাতখামার বিট এলাকার, অফিসার আয়ুব খানের সাথে কথা বলে জানা যায়।
বন বিভাগের চিঠি পাওয়ার সাথে সাথেই সাত খামাইর বিট এলাকার মধ্যে সাতটি করাত কল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং পাঁচটি করাত কল মালিক কে মামলা দেওয়া হয়েছে, আরো পাঁচটি করাত কলের মানিকদের কে মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। উপজেলার কাওরাইদ বিট এলাকায়, সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই এলাকার অধিকাংশই করাত কল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা বলে বেশ কয়েকটি করাত কল এখনো চলতে দেখা গেছে এ বিষয়ে কাওরাইদ বিটের বন কর্মকর্তা বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক করাত কল মালিক প্রতিবেদককে বলেন, কাওরাইদ বিটের বন কর্মকর্তা প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে মাসোহারা নেন চলতি মাসের ২ তারিখেও এই মাসোহারা নিয়েছেন।
উপজেলার ২ নং গাজীপুর ইউনিয়নের সিমলাপাড়া বিট এলাকায় সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাশবাড়ি, গোতার বাজার,শৈলাট বাঁশবাড়ি, গাজীপুর বাজার সহ প্রায় ৩০ টি অবৈধ করাত কল, বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও চালু রেখেছেন। বাঁশবাড়ি এলাকার স্থানীয় করাত কল ব্যবসায়ী রূপচাঁন মিয়া জানান। আমাদের গাজীপুর ইউনিয়ন এলাকায় প্রায় ৩০ টি করাত কল রয়েছে এগুলো থেকে প্রতিমাসে আমরা স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী কাশেমের মাধ্যমে বন কর্মকর্তাকে মাসোহারা দিয়ে চালাচ্ছি। আমাদের উপর হামলা মামলা আসার আগে স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী কাশেম আমাদেরকে জানিয়ে দিবেন। এবং আমাদের এখানে কোন বন কর্মকর্তা আসেনি এবং করাত কল বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে কোন চিঠি আমাদেরকে দেয়নি।
এ বিষয়ে সিমলাপাড়া বিট কর্মকর্তা আকতার হোসেন প্রতিবেদক কে বলেন। আমি সিমলাপাড়া বিটে নতুন এসেছি অফিসিয়াল কাগজপত্র গোছাচ্ছি, ইতিমধ্যে কয়েকটি করাত কলের মালিক কে মৌখিকভাবে আমি জানিয়েছি, অবৈধ করাত কলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য, দুই-একদিনের ভিতরে আমি চিঠির মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করব। স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মাসোহারা নেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন। আমি কাশেম নামের কোন লোককে চিনি না, বন কর্মকর্তার দোহাই দিয়ে যদি কোন লোক বেয়ানি ভাবে টাকা উত্তোলন করে তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
করাত কল (লাইসেন্স) বিধিমালায় ২০১২-তে আরও বলা হয়েছে— সংরক্ষিত, রক্ষিত, অর্পিত বা অন্য যেকোনো ধরনের সরকারি বনভূমির সীমানা থেকে ন্যূনতম ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কিংবা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্থল সীমানা থেকে ন্যূনতম ৫ কিলোমিটারের মধ্যে করাত কল স্থাপন করা যাবে না। এছাড়া সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, উদ্যান ও জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থানের ২০০ মিটারের মধ্যে করাত কল স্থাপন করা যাবে না।
বিধিমালায় আরও বলা আছে, এই আইন কার্যকর হওয়ার আগে কোনো নিষিদ্ধ স্থানে করাত কল স্থাপন করা হয়ে থাকলে আইন কার্যকরের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। তা না করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তা বন্ধের জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
জাতীয় এই বিধিমালার কোনো তোয়াক্কা না করেই শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ করাত কল। বন বিভাগের ভূমির ১০ কিলোমিটারের বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাছাড়া একই বিধিমালায় অনুমোদিত স্থানে লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়ে করাত কল স্থাপন করা হলে সেগুলোর কার্যক্রম সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
এই বিধানও মানছে না কোনো করাত কল। বন ও পরিবেশ বিভাগের তদারকি ও যথাযথ পদক্ষেপের অভাব এ সংকট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো.মোখলেছুর রহমান, বাংলাদেশ সমাচারকে বলেন, অবৈধ করাত কল বন্ধের জন্য শ্রীপুর রেঞ্জের আওতাধীন যতগুলি বিট অফিস রয়েছে, প্রত্যেকটা বিট অফিসারের কাছে, অবৈধ করাত কল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য, চিঠি দেওয়া হয়েছে, ইতিমধ্যে উপজেলায় প্রায় অর্ধসতাধিক করাত কল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং যারা অবৈধ করাত কল এখনো চালু রেখেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে ভাওয়াল গড় বাঁচাও আন্দোলনের মহাসচিব, ড. এ কে এম রিপন আনসারী বলেন, যতদিন পর্যন্ত অসাধু বন কর্মকর্তা,অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ী দালাল শ্রীপুর উপজেলায় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত বন রক্ষার্থে বন বিভাগের কর্মীদের বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
ঢাকা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই, আগে অসাধুবন কর্মকর্তাদের কে এবং অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের কে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন তাহলেই শ্রীপুরের বনাঞ্চল বাঁচবে বলে আশা করি।