পারিবারিক কলহ, সঙ্গী নির্বাচনে ভুল, মানসিক চাপ, তীব্র বিষণ্নতা, যৌন হয়রানি, পড়াশোনার চাপ—এসব কারণে দিন দিন বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দারিদ্র্য, নতুন পরিবেশ মেনে নিতে না পারাও এর অন্যতম কারণ। জীবন ও সামাজিক দক্ষতার অভাবে বর্তমানে অনেক তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থী এই আত্মঘাতী পথ বেছে নিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তারা বলছেন, শুধু মানসিক দুশ্চিন্তা আত্মহত্যার প্রধান কারণ নয়, এর পেছনে রয়েছে প্রযুক্তিগত আসক্তি, অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক ও জীবন ধারণের দক্ষতার অভাব।
চলতি বছরের গেল কয়েক মাসে এসবসহ তুচ্ছ কারণেও সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে শত শত তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে রাজধানী ঢাকাতেই।
শুক্রবার (৬ অক্টোবর) রাজধানীর খিলগাঁওয়ে জামিয়া আক্তার রিয়া (১৭) নামে কলেজ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ ওঠে। সে খিলগাঁও গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।
ঘটনার সময় রিয়ার মা শাহানাজ বেগম ছোট মেয়েকে নিয়ে কোচিংয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখতে পান দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে কোনও সাড়াশব্দ পাননি। পরে দেখতে পান গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে রিয়া। আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রিয়ার মা বলেন, ‘রিয়া কলেজে পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছে। হয়তো সে কারণেই সে এমনটা করছে। এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ দেখছি না।’
এর আগে গত ১৬ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডা. আলিম চৌধুরী ছাত্রী নিবাসের জয়াকুণ্ড (২২) নামে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ঢামেকের এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
মৃত জয়াকুণ্ডের রুমমেট পৃথুলা রায় জানান, জয়া অনেক দিন ধরে বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। এ কারণে তার কাউন্সেলিং করানো হচ্ছিল। ফাঁস লাগানোর এক দিন আগেও নতুন চিকিৎসক তার কাউন্সেলিং করেন। ওই দিন সকালে তাদের রুমমেট লাবণী রায় নিজের কাজে বের হন। এরপর আনুমানিক ১০টার দিকে জয়াকে রুমে রেখে বের হন পৃথুলাও। তিনি সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারেন জয়া গলায় ফাঁস দিয়েছেন। হোস্টেলে ফিরে এসে তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর চিকিৎসক তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গত ২ জুন রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় নিজ বাসা থেকে সরকারি কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ওয়াসিম রানার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ওয়াসিম গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে কী কারণে আত্মহত্যা করেছেন, ওই সময় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
ঘটনার পর ওই রাতের দেড়টার দিকে হাসপাতালের সামনে সানজিদা আক্তার (জান্নাতি) নামে এক নারীকে আহাজারি করতে দেখে পুলিশ। পরে পুলিশ জানতে পারে, ওয়াসিম রানার সঙ্গে ওই নারীর বিয়ে হয় সাত বছর আগে। এত দিন বিষয়টি কাউকে জানানো হয়নি। আত্মহত্যার এক সপ্তাহ আগে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। ওই সময় ওয়াসিম তার গায়ে হাত তোলেন। এ ঘটনার পর ওই নারীর মা-বাবা ওয়াসিমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে বলেন। ঘটনার দিন রাতেও ওয়াসিম তাকে বাসায় ফিরতে বলেন। না গেলে আত্মহত্যা করার হুমকি দেন।
পুলিশ বলেছে, সানজিদা বলেছেন, ‘ও এমনটা করবে আমি ভাবতেই পারিনি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে, এমন পাঁচটি মামলা শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছে। তাদের মধ্যে চার জনের বয়স ২৭-এর নিচে। তাদের মধ্যে একজন তরুণ, তিন জন তরুণী এবং অন্যজন পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ।
এ ছাড়া গত ১ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী এলাকার বাসায় ফেসবুক লাইভে এসে এক যুবক গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা চেষ্টা চালান। তিনি রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ ফরিদ (২৬)।
ঘটনাটি ডিবির সাইবার ক্রাইম টিমের নজরে এলে এক কর্মকর্তা দ্রুত রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলামকে জানান। তারা গিয়ে বাসার নিচতলা থেকে দরজা ভেঙে যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। দাম্পত্য কলহ, নাকি অন্য কোনও কারণে তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক কিছু জানাতে পারেননি ওসি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আত্মহত্যার পর ঢামেকে নিয়ে আসা অধিকাংশ মরদেহ শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীর। ছোটখাটো নানা ইস্যু নিয়ে আত্মহত্যা করছে, এমন মরদেহ প্রায় প্রতিদিনই আসছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গড়ে ৪৫ দশমিক ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। যেখানে স্কুলশিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ জন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩০ জন। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে পুরুষ শিক্ষার্থী ছিল ১৪৭ জন। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থী ছিল ২১৪ জন। এবারও ঢাকা বিভাগ রয়েছে আত্মহত্যার শীর্ষে।
২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। এ ছাড়া আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরা। গত আট মাসে আত্মহত্যা করা ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশই নারী শিক্ষার্থী।
একই সময়ে ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেছিল ৩৬৪ জন। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, নার্সিং প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছে। লক্ষণীয় যে ৩৬৪ জন আত্মহত্যাকারীর মধ্যে ১৯৪ জনই ছিল স্কুল-শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কলেজ-শিক্ষার্থী, যার সংখ্যা ৭৬। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারীর সংখ্যা ৫০। তবে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীও ছিল ৪৪ জন।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এ বিষয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, এর আগের আত্মহত্যার তথ্যগুলোয় আমরা দেখেছি, আত্মহত্যার পেছনে প্রেমঘটিত সম্পর্কের দায় বেশি থাকে, কিন্তু এবার ভিন্ন তথ্য সামনে আসছে। আত্মহত্যার পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যা পরিবারের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক কতটুকু মজবুত, তা নিয়ে চিন্তার উদ্রেক করছে। গত বছর আত্মহত্যার পেছনে করোনা একটা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। এ বছর করোনা না থাকলেও আত্মহত্যার খুব একটা হেরফের হয়নি। এটা আমাদের আতঙ্কিত করে তুলে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে আত্মহত্যার মতো যেসব ঘটনা দেখা যায়। এগুলো বেশির ভাগই আবেগতাড়িত ঘটনা। আত্মহত্যা কোনোভাবেই কোনও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয়। এ বয়সে বিভিন্ন রকম জটিলতা তাদের মাঝে তৈরি হয়। সেটা একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করা হতে পারে, সঙ্গী নির্বাচনে সমস্যা হতে পারে, আর্থিক সমস্যা হতে পারে, লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় মানসিক চাপ সামাল দিতে না পারলে অনেকে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। কারণ তাদের যে সামাজিক ক্ষমতা, সামাজিক চাপ মোকাবিলার দক্ষতা, জীবনের যে দক্ষতা, এ জায়গাগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যখন কারও মধ্যে সামাজিক ও জীবনদক্ষতা কম থাকে, তখন সে চাপ মোকাবিলা করতে পারে না। এর আরেকটি কারণ হচ্ছে, এখনকার ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে অনেকটা আত্মকেন্দ্রিকভাবে। এ ছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ার কারণ তো আছেই।’
দক্ষতা তৈরি করার জন্য আবশ্যিক ও সামাজিক মিলমিশ দরকার জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব তার বাইরের খেলার মাঠ—সবকিছুই জীবনদক্ষতার সহায়ক। অনেক সময় দেখা গেছে, খেলার মাঠে কোনও একটি ম্যাচ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। ওই দ্বন্দ্ব সমাধান করাও একটা দক্ষতা। সেখানে তারা শেখে, কোনও দ্বন্দ্ব বা সমস্যা তৈরি হলে কীভাবে এসব সমাধান করতে হয়। এতে তার দক্ষতাও তৈরি হচ্ছে। বাড়ে কঠিন সময় মোকাবিলার সাহসিকতা।
সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, এখনকার বাচ্চারা এসবে যুক্ত হচ্ছে কম। তারা একটা স্বপ্নময় জগতে বেড়ে উঠছে। অর্থাৎ ভার্চ্যুয়াল একটি জগতে বেড়ে উঠছে। যেটি বাস্তব জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। অনেক সময় মা-বাবার বেষ্টনী থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন জীবনে যাচ্ছে। তখন তারা বাস্তব জীবন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।