‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সঠিক অর্থ কি আপনার জানা আছে? আপনি যে অর্থটি জানেন সেটি কি সঠিক? মৃত্যুর আগে একটু যাচাই করে দেখুন তো! আমরা যারা বাঙালি তথা অনারব তাদের অধিকাংশ মুসলিম ভালো করে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থ কী, তা জানি না। অনারব অধিকাংশ মুসলিম যারা সজ্ঞানে এ কথার সাক্ষ্য দেয়, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, তারা প্রকৃতপক্ষে এই বাক্যটির সত্যিকার অর্থ কী তা জানে না; বরং অনেকসময় দেখা যায়, তারা সম্পূর্ণ উল্টো বা বিপরীত অর্থটিই জানে। যেমন কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ কী? সে জবাব দেয়- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’ অথবা ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই’। কিন্তু ‘ইলাহা’ এবং ‘মাবুদ’ দুটোই আরবি শব্দ। আসলে ‘ইলাহ’ শব্দটির মানেই তারা বোঝে না। এখানে তারা পুরো বাক্যটির অনুবাদ কিন্তু করেনি। তারা ‘ইলাহা’ এবং ‘মাবুদ’ আরবি শব্দদ্বয়ের অনুবাদ করেনি। তাহলে এই ‘ইলাহ’ শব্দটির আসল অর্থ কী?
কেউ কেউ বলেন- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই’। এটিও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র আসল অর্থ নয়। কেননা ‘সৃষ্টিকর্তা’-এর আরবি ‘খালিক’। তাই এখানে সৃষ্টিকর্তা ‘ইলাহ’ শব্দটির সঠিক অনুবাদ নয়। ‘ইলাহ’ শব্দটির অনুবাদকে অনেকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ধরে বলে যে- আমি তো আল্লাহকেই সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেছি। তাহলে আমার তো ঈমান আছে, আমি তো ঈমানদার। যদি আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করলেই ঈমানদার হওয়া যেত তাহলে নবী সা:-এর যুগের আরবের মুশরিকরাও আপনার চেয়ে বড় ঈমানদার ছিল। কিন্তু তারপরও আল্লাহ তাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করেছেন। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না? আরবের মুশরিকরা আপনার চেয়ে বড় ঈমানদার ছিল!
দেখুন কুরআন নিজেই তার প্রমাণ- ‘তোমরা যদি এসব লোককে জিজ্ঞেস করো : জমিন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছে, তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, ‘ওইগুলো সেই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা জুখরুফ-৯) ‘যদি তোমরা এদের জিজ্ঞেস করো, কে এদের সৃষ্টি করেছে তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে?’ (সূরা জুখরুফ-৮৭) ‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো পৃথিবী ও আকাশগুলো কে সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন তাহলে অবশ্যই তারা বলবে- আল্লাহ, এরপর এরা প্রতারিত হচ্ছে কোন দিক থেকে?’ (সূরা আনকাবুত-৬১) ‘আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত ভূমিকে সঞ্জীবিত করেছেন, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে- আল্লাহ। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য কিন্তু অধিকাংশ লোক বোঝে না।’ (সূরা আনকাবুত-৬৩) ‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বসবাস করে তারা কার? তারা নিশ্চয় বলবে- আল্লাহর। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয়ই বলবে- আল্লাহ। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কার কর্তৃত্ব চলছে প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তাঁর মোকাবেলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না? তারা নিশ্চয়ই বলবে- এ বিষয়টি তো আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত।’ (সূরা মু’মিনুন : ৮৪-৮৯) ‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, ‘কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিজিক দেন? এই শোনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা?’ তারা নিশ্চয়ই বলবে- আল্লাহ।’ (সূরা ইউনুস-৩১) ‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী কে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে- আল্লাহ।’ (সূরা লোকমান-২৫) ‘তোমরা যদি এদের জিজ্ঞেস করো, জমিন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছেন? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে- আল্লাহ।’ (সূরা জুমার-৩৮)
এমন আরো বহু আয়াত প্রমাণ করে, সেই সময়ের মুশরিকরা আল্লাহকে শুধু ‘সৃষ্টিকর্তা’ হিসেবেই মান্য করত না; বরং আরো অনেক কিছুর মালিক হিসেবেই বিশ্বাস করত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- ওই মুশরিকরা আল্লাহকে ‘সৃষ্টিকর্তা’ এবং আরো অনেক কিছুর মালিক হিসেবেই বিশ্বাস করার পরও আল্লাহ কেন তাদেরকে ধ্বংস করলেন? আল্লাহ কেন তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে শাস্তি দেবেন? উত্তর হচ্ছে- তারা আল্লাহকে ‘ইলাহ’ হিসেবে মানত না। আসুন ‘ইলাহ’ শব্দটির সঠিক অর্থটি বুঝার চেষ্টা করি। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই’।
এখানে ‘মাবুদ’ শব্দটি আরবি, এই শব্দটি এসেছে ‘ইবাদাহ’ শব্দ থেকে যার অর্থ হচ্ছে গোলামি করা। অর্থাৎ আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করা যাবে না। আসলে ইবাদত শব্দটি আমরা সচরাচর ব্যবহার করলেও শব্দটিও কিন্তু আরবি। ইবাদত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘গোলামি করা’। ইবাদত শব্দের আরেকটি অর্থ হয়- উপাসনা করা, আরাধনা করা ইত্যাদি।
তাহলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামি করা যাবে না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানা যাবে না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো কথা শোনা যাবে না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো কথা মানা যাবে না, বাবা-মায়ের কথা মানা যাবে না, নেতার কথা মানা যাবে না, শাসকের কথা মানা যাবে না, এক কথায় আল্লাহর হুকুম আহকামের বিপরীতে আর কারো কথা মানা ও শোনা যাবে না। এমনকি নিজের কথাও না।
একমাত্র আল্লাহ যেটি বলবেন সেটিই মানতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করতে, তাই আমরা মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করি; আল্লাহ বলেছেন- রাসূলের আনুগত্য করতে, তাই আমরা রাসূলের আনুগত্য করি; আল্লাহ বলেছেন- সত্য কথা বলতে, তাই আমরা সত্য কথা বলি; আল্লাহ বলেছেন- সালাত কায়েম করতে, তাই আমরা সালাত কায়েম করি ইত্যাদি।
অথচ ইবরাহিম আ: তাঁর পিতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু কেন? কারণ আল্লাহ বলেছেন। তাহলে বোঝা গেল, আল্লাহ বললে- বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, আবার আল্লাহ বললে- পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর কথাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। আল্লাহর কথার উপরে কারো মায়া-মুহাব্বত চলে না। এটিই হচ্ছে ‘ইলাহ’ এর বাস্তবতা।
মহান আল্লাহ বলেন- ‘তুমি কি তাকে দেখো না, যে তারা প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার জিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে করো, তাদের অধিকাংশ শোনে অথ বোঝে? তারা তো চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং আরো পথভ্রান্ত।’ (সূরা ফুরকান : ৪৩-৪৪)
তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কথা মানা যাবে না, আল্লাহর আদেশের সামনে মাথা নত করে দেয়ার নামই হচ্ছে মূলত আল্লাহকে ‘ইলাহ’ হিসেবে মেনে নেয়া। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া হুকুম-আহকাম দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। কেউ হুকুম-আহকাম দিলেও আমি তা মানব না। আমি তো শুধু একমাত্র আল্লাহরই গোলামি করি। আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামি আমি করতে পারি না, করলে সেটি শিরক হবে।
এভাবে কোনো একজন মানুষ আল্লাহকে ‘ইলাহ’ হিসেবে ভালোভাবে বুঝে-সজ্ঞানে আল্লাহকে ‘ইলাহ’ হিসেবে মনেপ্রাণে মেনে নিয়ে অতঃপর মুখে সাক্ষ্য দিলে তবেই সে হবে ঈমানদার। আর এ বিষয়টিই তৎকালীন আরবের লোকেরা বুঝত, কারণ তাদের ভাষাই তো আরবি। ফলে তারা আল্লাহর গোলামি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই তারা মুখে মুখে সাক্ষ্যও দিত না। কিন্তু আমরা তো ছোটবেলা থেকে না বুঝেই আল্লাহকে ‘ইলাহ’ হিসেবে মেনে নেয়ার সাক্ষ্য দিই। অথচ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো হুকুম-আহকাম, বিধিবিধানও মেনে নিই।
তাই আজ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সঠিক অর্থ জানার পর চিন্তা করে দেখুন আপনি কি একমাত্র আল্লাহর গোলামি করতে প্রস্তুত আছেন? আপনি কি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ ছাড়া হুকুম-আহকাম, বিধিবিধান দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ ছাড়া হুকুম-আহকাম, বিধিবিধানের সামনে মাথা নত করে দেয়ার মতো ইচ্ছা কি আপনার আছে? তাহলে মন থেকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক