প্রথমবারের মতো দেশে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চালু হচ্ছে ইন্টার্নশিপ। এমন সুযোগ রেখে সম্প্রতি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ (ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ) নীতিমালা, ২০২৩’ এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি বছর ইন্টার্নশিপ হবে তিন থেকে ছয় মাসব্যাপী। এতে লাভবান হবে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি– দুই পক্ষই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে লাখ লাখ পদ এখনো খালি রয়েছে। এ কারণে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় লাগছে। ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে কাজের গতি আরও বাড়বে।
তারা বলছেন, ইন্টার্নশিপ করার মাধ্যমে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। এছাড়া ভাতা পাওয়ার মাধ্যমে আর্থিকভাবেও লাভবান হবেন তিনি।
সরকারি চাকরিতে ৪ লাখ ৮৯ হাজার পদ খালি
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রকাশিত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে শূন্যপদের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭৬টি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রশাসনে মোট অনুমোদিত ১৯ লাখ ১৫১টি পদের বিপরীতে কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পর্যায়ে ২১ হাজার ৭০৯টি পদের মধ্যে শূন্য ৬ হাজার ৮২১টি পদ, সংস্থা ও অধিদপ্তর পর্যায়ে ১৪ লাখ ২২ হাজার ৮২৮টি পদের মধ্যে শূন্য ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৬টি পদ। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক অফিসে ৪০ হাজার ২৭৩টি পদের মধ্যে পদ খালি রয়েছে ১৩ হাজার ৩৫৭টি পদ। বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং কর্পোরেশনে মোট খালি পদ এক লাখ ৫৭ হাজার ৮১৯টি পদ, এখানে মোট পদের সংখ্যা ৪ লাখ ১৫ হাজার ৩৪১টি।
এখন সরকারি চাকরিতে প্রথম থেকে নবম গ্রেডের (আগের প্রথম শ্রেণি) ২ লাখ ৪৪ হাজার ৯৬টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৫১৪ জন। ফাঁকা আছে ৬৪ হাজার ৫৮২টি পদ।
১০ম থেকে ১২তম গ্রেডে (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) ২ লাখ ৯১ হাজার ১১১টি পদের বিপরীতে কাজ করছেন ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬৬৪ জন। ফাঁকা রয়েছে ৯৭ হাজার ৪৪৭টি পদ।
আরও পড়ুন : সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ করা যাবে না
১৩তম থেকে ১৬তম গ্রেডে (আগের তৃতীয় শ্রেণি) ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৪০টি পদ রয়েছে। এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৬ লাখ ৩ হাজার ৪৩৩ জন। ফাঁকা আছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬০৭টি পদ।
অন্যদিকে, ১৭তম থেকে ২০তম গ্রেডে (আগের চতুর্থ শ্রেণি) ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬৯টি পদ রয়েছে। এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪ লাখ ১৫ হাজার ১০৪ জন। ফাঁকা রয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৬৫টি পদ।
আর সরকারি দপ্তরে নির্ধারিত ও অন্যান্য কাজের জন্য ১১ হাজার ৪৩৫টি পদ রয়েছে। এসব পদের বিপরীতে কাজ করছেন ৫ হাজার ১০৩ জন। ফাঁকা রয়েছে ৬ হাজার ৩৩২টি পদ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৭টি পদ, ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ, ২০২০ সালে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ এবং ২০২১ সালে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ ফাঁকা ছিল।
পদ খালি থাকায় কাজের গতি ‘মন্থর’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতি বছরই সরকারি চাকরিতে লাখ লাখ পদ খালি থাকছে। এ কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের গতি অনেক মন্থর।’
‘ধরুন একটি প্রতিষ্ঠানে লোক দরকার ৫০ জন কিন্তু সেখানে আছে মাত্র ৩০ জন। তাহলে তো সেই প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি কম থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকবল কম থাকার কারণে কাজের গতিও অনেক কম। এটা বাস্তব চিত্র।’
ইন্টার্নশিপে কাজের গতি বাড়বে, লাভবান হবেন সুযোগ পাওয়া ব্যক্তিও
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতি বছর সরকারি প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ পদ খালি থাকছে, সে পরিমাণে কিন্তু নিয়োগ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে ঘাটতি কিছুটা হলেও লাঘব হবে, কাজের গতিও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাওয়া ব্যক্তিও কিন্তু অনেক উপকৃত হবেন। কারণ, স্নাতক শেষ করে একজন চাকরিপ্রার্থী যখন চাকরি খুঁজতে যান, তখন তিনি দেখেন অধিকাংশ জায়গায় অভিজ্ঞতা চাওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পেলে সেটা পরবর্তীতে চাকরির ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবেন। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দুটোই তিনি সঞ্চয় করতে পারবেন। এছাড়া তাকে তো নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দেওয়া হবে। এতেও তিনি লাভবান হবেন। সব মিলিয়ে দুপক্ষই এতে লাভবান হবে।’
যা আছে নীতিমালায়
নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ সৃষ্টি, পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার সমন্বয় এবং সরকারি দপ্তরের কাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাবেন। গ্র্যাজুয়েশনের দুই বছরের মধ্যে আবেদন করতে হবে। ইন্টার্নশিপের মেয়াদ হবে তিন থেকে ছয় মাস। ইন্টার্নরা প্রতি মাসে নির্ধারিত ভাতা পাবেন।
নীতিমালা অনুযায়ী, একজন প্রার্থী একবারই সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাবেন। ইন্টার্নশিপের মাঝে কেউ যদি অন্য জায়গায় চাকরি পেয়ে যান, তাহলে তিনি ইন্টার্ন অসমাপ্ত রেখেই চলে যেতে পারবেন।
যেভাবে বাছাই করা হবে
সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থা তাদের চাহিদার কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে জানাবে। বাছাইয়ের জন্য ইন্টার্নশিপের স্থান, সংখ্যা, সময়কাল, বিশেষ দক্ষতা, ভাতাসহ বাছাই প্রক্রিয়ার বিষয়টি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে।
এরপর সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন এবং আবেদনকারীদের একাডেমিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত মেধা অনুযায়ী ইন্টার্ন বাছাই করা হবে। ইন্টার্নশিপ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ তিন থেকে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠনের মাধ্যম এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
ইন্টার্নের কার্যক্রম সন্তোষজনক না হলে, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত হলে, অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে, অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে, দাপ্তরিক আদেশ অমান্য করাসহ কর্তৃপক্ষ মনে করলে যেকোনো সময় ইন্টার্নশিপ বাতিল করতে পারবে।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন– মন্ত্রণালয়, বিভাগ, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক বছর ইন্টার্ন করার সুযোগ দেবে। সেটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা ডিপার্টমেন্ট ঠিক করবে। সেখানে তাদের (ইন্টার্নদের) একটা ভাতাও দেওয়া হবে।
তিনি জানান, তারা কী কাজ করবেন– এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে বসবে। তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদে তারা কাজ করবেন।
জনবলের সংকট থাকা প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে জনবলের সংকট আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এর ব্যত্যয় হলে গোলমাল হতে পারে।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যেখানে জনবল যথেষ্ট আছে সেখানে এটি ভালো হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে যেসব জায়গায় জনবলের সংকট আছে, সেসব জায়গায় এটা দিতে পারে।’
উদাহরণ দিয়ে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সচিবালয় অতিরিক্ত জনবল দিয়ে চলছে। এ জায়গায় ইন্টার্ন আনলে আরও গোলমাল হবে। তাই যেখানে জনবলের সংকট আছে, সেখানে সুযোগটা দেওয়া যেতে পারে।’