হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমসের গুদামে সুরক্ষিত লকার থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ লুটের পর রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণ মার্কেটে সেগুলো বিক্রি করেছে লুটেরার দল। বায়তুল মোকাররমের চোরাই স্বর্ণ বেচাকেনায় জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে লুটেরাদের মধ্যে দুজনের। মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি চক্রের দুই সদস্য একাধিকবার বায়তুল মোকাররমে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিংও করেছেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানিয়েছেন, এ কান্ডে কাস্টমসের দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাসহ তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার। এ তিনজনকে আজ বুধবার আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হতে পারে।
পুলিশ জানিয়েছে, ৫৫ কেজি স্বর্ণ লুটের কা-ে অভিযান চালানো হয়েছে সন্দেহভাজনদের বাসায়। তবে গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত লুট হওয়া কোনো স্বর্ণ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। থানাপুলিশ থেকে গতকাল মামলার তদন্ত হস্তান্তর করা হয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় এমন সুরক্ষিত এলাকা থেকে স্বর্ণ লুট করা হয়েছে। ঊর্ধবতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া দীর্ঘসময় ধরে এভাবে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ লুটপাট করা সম্ভব নয়। লুটের নেপথ্যে কাস্টমসের মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে রাঘববোয়ালদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো তথ্য বের করতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম শাহেদ এবং সহযোগী হিসেবে সিপাহি নিয়ামত হাওলাদারই স্বর্ণ উধাও হওয়ার কান্ডে পুলিশের প্রধান টার্গেট। সন্দেহভাজন এ তিনজন ঘটনার আগে-পরে এবং ঘটনার দিন বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে একত্রিত হয়েছেন; যেটা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদকালেও বিভিন্ন রকম অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। এসব বিবেচনায় শহিদুল ও শাহেদ এ ঘটনায় জড়িত বলে আমরা ধারণা করছি। এর সঙ্গে ছিলেন সিপাহি নিয়ামত হাওলাদারও। ডিউটির সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তাদের এয়ারপোর্ট চত্বর ও বাইরে একসঙ্গে অবস্থান করার বিষয়টি প্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
স্বর্ণ কোথায় বিক্রি করেছে?- এমন প্রশ্নে ডিএমপির ডিসি বলেন, এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। আমরা স্বর্ণের গন্তব্য প্রযুক্তিসহ সোর্সের মাধ্যমে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। যেসব জায়গায় স্বর্ণ বেচাকেনা হয়, সেসব জায়গায় খোঁজ নিচ্ছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টমস গুদামের স্বর্ণের ভল্টে প্রবেশ করতে হলে ছয় স্তরের নিরাপত্তা ও গেটকিপিং পার হতে হয়। শুরুতে পাঞ্চ কার্ড। এর পর কলাপসিবল গেট। সেই গেটে দেহতল্লাশি হয়। স্বর্ণ বা বুলিয়ন ভল্ট পর্যন্ত ৩টি ভল্টের দরজা রয়েছে। আর সেই ভল্টে প্রতিটি আলমারির পৃথক চাবি। এসব চাবি থাকে সিন্দুকে। আর এর দায়িত্বে থাকেন মাত্র দুজন। রাতে ভল্ট বন্ধ করার পর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এমতাবস্থায় ঊর্ধŸতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া স্বর্ণ চুরি এক কথায় অসম্ভব!
পুলিশের ডিসি মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, গোডাউন ছিল অবহেলিত অবস্থায়। অস্থায়ী গোডাউনে তারা স্বর্ণ রেখেছে। পাশেই মূল্যবান পণ্য রাখার ব্যবস্থা থাকলেও রাখা হয়নি। উপরন্তু তিন মাসের মধ্যে স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও জমা দেওয়া হয়নি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণ লুটের ঘটনায় সন্দেহভাজনরা ডিউটি টাইমের বাইরেও দীর্ঘসময় বিমানবন্দরে অবস্থান করতেন। বিমানবন্দরের বাইরে তারা একত্রে মিটিং করেছেন। তাদের মিটিংয়ে চোরাই স্বর্ণের ক্রেতারা ছিলেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সন্দেহভাজন দুই কাস্টমস কর্মকর্তা শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। তারা স্বর্ণ লুটের সুযোগ দিতে ভল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করে রেখেছিলেন। এসব ঘটনায় এখন কাস্টমস কর্মকর্তারা মুখ খুলছেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও নীরব।
ঢাকা কাস্টমসের সুরক্ষিত ভল্ট থেকে স্বর্ণ লুটের বিষয়টি জানাজানি হয় গত রবিবার। এ ঘটনায় চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয় পুলিশ। শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫০১ গ্রাম সোনা খোয়া গেছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। সাধারণত বিমানবন্দরে যাত্রীদের কাছ থেকে জব্দ করা সোনার বার, অলংকারসহ মূল্যবান জিনিস এই গুদামে রাখা হয়। গুদামে রক্ষিত স্বর্ণের হিসাব মেলাতে গিয়েই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্র সুকৌশলে কাস্টম হাউস থেকে জব্দ স্বর্ণ সরিয়ে ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে সরানো হয়েছে, নাকি একবারেই গায়েব করা হয়েছে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে ঘটনার সঙ্গে একটি বড় এবং শক্তিশালী চক্র জড়িত এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
মামলা ডিবিতে হস্তান্তর : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমস থেকে স্বর্ণ চুরির মামলা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের এক নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব থানাপুলিশ থেকে ডিবিকে দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব কমিশনারের নির্দেশে ডিবিকে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে ডিবি এটি তদন্ত করবে।