এক দফা দাবিতে ফের জোরালো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলটি তফসিলের আগে, অক্টোবরের মাঝামাঝিতে আন্দোলনকে চূড়ান্ত একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চায়। বিএনপির হাইকমান্ড কর্মসূচি নির্ধারণ নিয়ে গত রোববার সিনিয়র নেতাদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে। এর ধারাবাহিকতায় গত রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। জানা গেছে, আন্দোলনের শেষ ধাপে ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। অক্টোবরের শুরু থেকে এই কর্মসূচি মাঠে গড়াতে পারে।
জানা গেছে, গত রোববার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হাইকমান্ডের সাথে তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে দলের সিনিয়র নেতারা আগামী দিনের আন্দোলন নিয়ে নানা মতামত দেন। তারা মনে করেন, নির্বাচনের তফসিল পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি টেনে নেয়া ঠিক হবে না। এর আগেই রাজপথে শক্ত কর্মসূচি দিয়ে এক দফার ফায়সালা করতে হবে।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংবিধানে জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে। আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে। তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। সে হিসাবে, ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে এই নির্বাচন করতে হবে। বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তারা।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে এক দফার যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সর্বশেষ গত ২৫ ও ২৬ আগস্ট ঢাকাসহ দেশব্যাপী কালো পতাকা গণমিছিলের কর্মসূচি পালিত হয়। এরপর পয়লা সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির কারণে যুগপৎ আন্দোলনে সাময়িক বিরতি ঘটে।
দলটির খসড়া আন্দোলন পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী শুক্রবার থেকে পুনরায় মাঠে গড়াতে পারে এক দফার যুগপৎ আন্দোলন। আগামী দুই সপ্তাহ প্রতি শুক্র ও শনিবার মানববন্ধন, পদযাত্রা, গণমিছিল ও সমাবেশের মতো কর্মসূচি আসতে পারে। এই কর্মসূচি হতে পারে যৌথভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। আর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে গিয়ে কর্মসূচির ধরনে আসতে পারে পরিবর্তন। সেই সময় ঢাকায় ফের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচির চিন্তা রয়েছে হাইকমান্ডের। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরু হবে। তখন কর্মসূচি হবে ফের ঢাকাকেন্দ্রিক। বিচারালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে শেষ ধাপের সেই আন্দোলন শুরু হবে। এরপর ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসবে। সাথে টানা অবস্থানের কর্মসূচি দেয়ারও চিন্তা রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের।
এক দফা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা একটা ধারাবাহিক ও যুগপৎ আন্দোলনের ভেতরে আছি। নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন ও আন্দোলন কৌশল নিয়ে দুই-এক দিনের মধ্যে আমরা বিএনপির সাথে বসব। সম্ভাবনা আছে, অল্পদিনের মধ্যেই আমরা আবার যুগপতের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে হাজির হতে পারব। আশা করছি, এবারের আন্দোলনে মাঝখানে আর বড় ধরনের বিরতি থাকবে না। শান্তিপূর্ণভাবে ধারাবাহিক ও টানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা আন্দোলনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারব।
জানা গেছে, গত রোববার রাতে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং যুগ্ম মহাসচিবদের মতামত নেয় বিএনপি। ওই বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ছাড়া সেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, ড. আব্দুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন। তাদের সাথে ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক এবং যুবদলের সভাপতি ও ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।
জানা গেছে, ওই বৈঠকে কয়েকজন নেতা বলেছেন, গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি সফল না হওয়ার পেছনে সমন্বয়হীনতা ছিল।
ঢাকা মহানগরীর কর্মসূচিতে আশপাশের জেলা অংশ নিতে পারে। কিন্তু দূরের জেলার কাছে ঢাকার নেতাদের মতো কর্মদক্ষতা আশা করা ঠিক হয়নি। চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে পুলিশ স্টেশন, আদালত, সচিবালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ ঢাকা ঘেরাওয়ের কর্মসূচির পক্ষে মতামত তুলে ধরেন। নেতারা আরো বলেন, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বৈঠকে তিনজন নেতা তাদের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, যেভাবে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলায় আদালত যেভাবে সাজা দেয়া শুরু করেছে, এর প্রতিবাদে আদালত ঘেরাও কর্মসূচি দিতে হবে। তবে দুই নেতা বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ চলমান আন্দোলন ঠিক পথে আছে। এই আন্দোলন অব্যাহত রেখে ঢাকা ও ঢাকার আশাপাশের জেলার সাংঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কোনো অবস্থায় হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে না। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক নয়; আন্দোলন সফল করতে সারা দেশ নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণে মতামত দেন। একজন নেতা বলেন, গত ২৯ জুলাই আন্দোলনের প্রথম ধাপ ছিল। এখন চূড়ান্ত ধাপে যেতে হবে। এই সময়ে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার জন্য মতামত দেয়া হয়।
বৈঠকে হাইকমান্ডের পক্ষ থেকেও আন্দোলন সফলে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সামনের আন্দোলনে আর কোনো ভুল করার সুযোগ নেই। সমন্বিতভাবে ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপির চূড়ান্ত টার্গেট হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। বিএনপি সেই লক্ষ্য নিয়ে অবিচলভাবে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে বিএনপির আন্দোলন ভুল পথে পরিচালিত করার চরম উসকানি রয়েছে। তারা এক দিকে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে বহিঃবিশ্বের কাছে ভুল বার্তা দিতে চায়, অন্য দিকে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা চালিয়ে আন্দোলন দমাতে চায়। তারা ভেবেছে অতীতের মতো এবারো এই ধরনের কূটকৌশল কাজে আসবে। আসলে তারা চরম ভ্রান্তির মধ্যে আছে। তিনি বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। টার্গেটে না পৌঁছা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।