অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ স্থানান্তর ও নতুন সংযোগ দেওয়ার অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ জুন সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের ছেলে মুজিবুর রহমান ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পর প্রায় দুই বছর তদন্ত শেষে গত ৩০ মার্চ এ মামলা থেকে সবাইকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় কমিশন। কিন্তু এ প্রতিবেদন গ্রহণ করেননি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুননেসার আদালত। পরে এ মামলায় মন্ত্রিপুত্রসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়। বিচারিক আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যান আসামিরা। সম্প্রতি এ মামলার কার্যক্রমের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন আদালত। এর পর থেকে মামলাটির বিচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে নিয়োজিত দুদকের প্যানেল আইনজীবী মাহমুদুল হক মাহমুদ আমাদের সময়কে জানিয়েছেন। বর্তমানে বিচারিক আদালত এবং উচ্চ আদালতে দুদকের ৬ হাজার ৯৮০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৭৮২টির বিচার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, স্থগিত মামলাগুলোর মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন, অর্থ পাচার, ঘুষ গ্রহণ, জালিয়াতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিচারিক
আদালতে তিন হাজার ২৭৫টি দুর্নীতির মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অন্যদিকে আপিল ও অন্যান্য আবেদন মিলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৩ হাজার ৭০৫টি দুর্নীতির মামলা।
দুদকের সর্বশেষ (জুন ২০২৩) পরিসংখ্যান বলছে, বিভিন্ন বিচারিক আদালতে কমিশনের দুই হাজার ৮৮৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে ২৪৮টি মামলার বিচার কার্যক্রম। অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে (বর্তমানে দুদক) দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে ৩৯২টি মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। এসব মামলার মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৮৩টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘উচ্চ আদালতসহ প্রতিটি কোর্টে আমাদের আইনজীবী রয়েছেন। যখন কোনো মামলা স্থগিত হয়, তারা চেষ্টা করেন মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার। আইজীবীদের আইনি যুক্তি শুনে আদালত সন্তুষ্ট হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। এভাবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে দুদকের দায়িত্বরত প্যানেল আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কোনো মামলার একাধিক আসামি থাকলে যে কোনো একজন আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ আসতে পারে। বেশকিছু মামলার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা দেখা যায়। আমার কাছে এমন কয়েকটি মামলা রয়েছে, যেগুলোর কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ রয়েছে। কোনো মামলার ওপর যখন হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আসে তখন সে বিষয়ে কমিশনকে অবহিত করা হয়। এরপর কমিশন উচ্চ আদালতে নিয়োজিত দুদকের আইনজীবীদের মাধ্যমে সেসব মামলা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে মোকাবিলা করে থাকে।’
সুপ্রিমকোর্টে দায়িত্বরত দুদকের অন্যতম জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘কোনো মামলার বিষয়ে স্থগিতাদেশ এলে সেই আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আমরা আপিল বিভাগে যাই। আদালতের কাছে আমাদের আইনি যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরি। এভাবে পুরনো অসংখ্য মামলা সম্প্রতি সচল হয়েছে, যেগুলোর ট্রায়াল কোর্টে পুনরায় বিচার চলছে।’
দুদক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সারাদেশের বিচারিক আদালতগুলোর মামলার মধ্যে ৭৯৬টি মামলা ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে, এর মধ্যে স্থগিত রয়েছে ১৩৬টি। আর ঢাকার বাইরে বিচারাধীন ২ হাজার ৪৮টির মধ্যে স্থগিত আছে ২৯৫টি মামলার কার্যক্রম।
এদিকে হাইকোর্ট বিভাগে মোট তিন হাজার ২১৯টি মামলা-আবেদন বিচারাধীন রয়েছে। অন্যদিকে আপিল বিভাগে বিচারাধীন ৪৮৬টি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগের ৬৭৬টি ও আপিল বিভাগে ১৩৬টি রিট মামলার মধ্যে ২২১টি স্থগিত রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে ৮২৯টি ও আপিল বিভাগের ১৮৫টি ‘ক্রিমিনাল মিস’ মামলার মধ্যে ৯৩টির কার্যক্রম স্থগিত আছে। হাইকোর্ট বিভাগে ১ হাজার ১৩৬টি ও আপিল বিভাগে ৭৩টি ক্রিমিনাল আপিল মামলার মধ্যে ১২টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত এবং হাইকোর্টের ৫৭৮টি ও আপিল বিভাগে ৯২টি ক্রিমিনাল রিভিশন বিচারাধীন মামলার মধ্যে ৬৯টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বিচারাধীন দুর্নীতির মামলাগুলোর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭৫টি মামলা কার্যক্রম স্থগিত ছিল। এর পর গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নতুন করে আরও ৩৯টি মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। তবে একই সময়ে ১৯টি মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছেন আদালত।
বিচারিক আদালতে গত জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ১৮৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে; এর মধ্যে ১১৪টি মামলায় সাজা, ৬১টি মামলায় খালাস ও ১৪টি মামলা অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ব্যুরোর আমলের ২৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে চারটি মামলায় সাজা হলেও ১৫টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। আর এ সময়ে ব্যুরোর আমলের চারটি মামলা অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তি হওয়া কমিশন ও ব্যুরোর মামলার মধ্যে ৬০ দশমিক ৩১ শতাংশ মামলার সাজা হলেও বাকি ৩৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ মামলার আসামি খালাস পেয়েছেন।
অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা মধ্যে গত জুন পর্যন্ত ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, এর মধ্যে কমিশনের পক্ষে ৪৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়। সেগুলোর মধ্যে একটা বড় অংশ জামিন সংক্রান্ত আবেদন। তবে জামিন বাদে কমিশনের পক্ষে ৮২ দশমিক ২৮ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। একই সময় বিচারাধীন আপিল বিভাগের মামলাগুলোর মধ্যে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, এগুলোর মধ্যে কমিশনের পক্ষে নিষ্পত্তির হার ৪৬ দশমিক ২০ শতাংশ।