প্রবাসী আয় সংগ্রহে ডলারের নির্ধারিত বিনিময় হার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এখনো কিছু কিছু ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি মূল্যে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করছে। মাসে এরূপ লেনদেনের পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ কোটি ডলার। ব্যাংকগুলোর এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে আমদানিতে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতিও চড়ছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নির্ধারিত বিনিময় হার পরিপালনে সর্বশেষ ব্যাংকার্স সভায় কঠোর বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। আগামীতে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে বেশি মূল্যে ডলার সংগ্রহের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আর্থিক জরিমানার পরিবর্তে কঠিন জরিমানা আরোপেরও হুশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, নির্ধারিত রেট অমান্য করে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করার কারণে বাজারে বিশৃঙ্খলা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে আমদানিতেও ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত রেটেই রেমিট্যান্স আনতে সর্বশেষ ব্যাংকার্স সভায় কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকগুলোর অভিপ্রায় থাকতে হবে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানব। আর যদি অভিপ্রায়ই থাকে মানব না, তা হলে উল্টাপাল্টা করে সবকিছুই করা সম্ভব। রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো একই কাজ করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখ ফাঁকি দিতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এই কৌশল ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অফিসিয়ালি ডকুমেন্ট নিয়ে তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো যদি নিজ থেকে ঠিক না হয়, তা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যতই তদারকি করা হোক না কেন, সেটা কাজে আসবে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের এপ্রিল থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন এই দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনকে (বাফেদা)। এরপর থেকে এবিবি ও বাফেদা কয়েক দফা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম বাড়িয়েছে।
তবে দুই মাস ধরে আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই এ দুই সংগঠন মিলে রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের দাম আবারও বাড়িয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, এখন থেকে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৮.৫০ টাকা, আগে যা ছিল ১০৭.৫০ টাকা। প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা, যা আগে ছিল ১০৮.৫০ টাকা। আর আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৯.৫০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়।
তবে কিছু কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার সংগ্রহ এবং আমদানিকারকদের কাছে তা বেশি মূল্যে বিক্রি করার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৬ আগস্ট দেশের সব ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় এ বিষয়ে তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলো হলোÑ বাফেদা ও এবিবির ঘোষিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করবে। যদি নিয়মবহির্ভূতভাবে বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়ের নজির পরিলক্ষিত হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো ওভারডিউ রপ্তানি আয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সভায় বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে মুদ্রার জোগান-চাহিদা পর্যালোচনায় করে এবিবি ও বাফেদা সম্মিলিতভাবে মুদ্রার বিনিময় হার ঘোষণা করে, যা সব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক কর্তৃক অনুসরণীয়। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া যায় যে, অনেক ব্যাংক ওই নির্দেশনা না মেনে বেশি দামে প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসন করে।
বাফেদার চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর বলেন, এরূপ কার্যক্রমে সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লেনদেন হয়। বেশি মূল্যে রেমিট্যান্স ক্রয় করার ফলে আমদানিকারকদের নিকট বেশি বিনিময় হারে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের ফলে পুরো বাজার ব্যবস্থা অনিয়মের শিকলে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যেও একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশি হারে রেমিট্যান্স ক্রয় করার জন্য ছয়টি ব্যাংককে আর্থিক জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। কয়েকটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল পরিদর্শন করছে এবং আরও কয়েকটি ব্যাংকে পরিদর্শন দল পাঠানো হচ্ছে। এ বিষয়ে অনিয়ম পাওয়া গেলে এবার টাকার অংকে জরিমানা করার পরিবর্তে কঠিন জরিমানা আরোপ করা হবে।
গভর্নর আরও বলেন, রপ্তানি আয় দেশের বৃহত্তম বৈদেশিক আয়ের উৎস; কিন্তু রপ্তানি আয়ের একটি অংশ সর্বদা অপ্রত্যাবাসিত থাকে। চলতি সময়ের প্রত্যাবাসনযোগ্য রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রত্যাবাসনযোগ্য রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারল্য বাড়বে। তখন বেশি দামে নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রবাসী আয় ক্রয়ের আবশ্যকতা থাকবে না।