আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে (জাপা) নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। গত রোববার তিন দিনের সফরে ভারতে গেছেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। অন্য দিকে কিছুদিন নীরব থাকার পর ফের সক্রিয় ভূমিকায় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদপন্থীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে জাতীয় পাটিতে দেবর-ভাবীর দ্বন্দ্ব বাড়ছে। দুই গ্রুপের তৎপরতা বাড়ার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের তৎপরতাও জোড়ালো হচ্ছে। রওশন এরশাদ এবং তার অনুসারীরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের (দশম ও একাদশ) নির্বাচনের মতো আওয়ামী লীগের বলয়ে থেকে আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। অন্য দিকে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা ইস্যুতে সরব রয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। আওয়ামী জোটে না যাওয়ার যে ইঙ্গিত দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত তার এ অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়েও কথা উঠছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলেও পার্টির সিনিয়র নেতাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে চায়। তাই আসন্ন নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পথেই হাঁটতে হতে পারে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি।
ভারত সফরে জি এম কাদের : আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আর বাকি প্রায় চার মাস। গত ৬-৮ আগস্ট ভারত সফর করে এসেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল। সরকারি দলের ভারত সফর করে আসার ১৫ দিন পার হওয়ার আগেই গতকাল রোববার দুপুরে দিল্লির পথ ধরেছেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার আসনে থাকা জি এম কাদেরের সাথে রয়েছেন স্ত্রী শেরিফা কাদের এমপি এবং দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মাশরুর মাওলা।
জাতীয় পার্টির সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আমন্ত্রণে জি এম কাদেরের এই সফরে ভারত সরকার ও দেশটির ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। ভারত সফর শেষে জি এম কাদেরের আজ মঙ্গলবার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে জি এম কাদের সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। রাজপথের আন্দোলনে না থাকলেও তার বক্তব্য মাঠের বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতের অনেক দাবির সাথেই মিলছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের আমন্ত্রণে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতার দিল্লি সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে।
সক্রিয় রওশন এরশাদপন্থীরা : দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। একই সাথে তিনি জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছেন তিনি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বিরোধী দলের ভূমিকাসহ নানা বিষয়ে কথা হয় বলে রওশন এরশাদের মিডিয়া উইং সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েও কথা হয় বলে জানায় মিডিয়া উইং।
রওশন এরশাদের সাথে ছিলেন তার ছেলে শাদ এরশাদ এমপি, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ এবং বিরোধী দলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশীদ।
২০১৯ সালে এরশাদ মারা যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হন তার ভাই জি এম কাদের। জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদেরের মধ্যে বিরোধ চলছে অনেক দিন ধরে। এখন আসন্ন নির্বাচনে দলের অবস্থান কী হতে পারে, এ নিয়ে তাদের বিরোধ আরো বেড়েছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন। জাতীয় নির্বাচন এলে প্রতিবারই জাতীয় পার্টিতে নানা তৎপরতা দেখা যায়, এবারো এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে গিয়ে বিজয়ী হয়ে সরকারের শরিক হয় জাতীয় পার্টি। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির পক্ষে সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন তার ভাই জি এম কাদের। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে চাননি এরশাদ। জাপার একাধিক সূত্র বলছে, এরশাদকে নির্বাচনে আনতে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ভারতের পক্ষ থেকেও চাপ দেয়া হয়। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপার শীর্ষ নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়। তখন থেকে আওয়ামী লীগ বলয়ে আস্থাভাজন এরশাদপতœী রওশন এরশাদ। তাকে করা হয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা। এরশাদ মারা যাওয়ার পর জি এম কাদের বিরোধী দলীয় নেতার দৌঁড়ে থাকলেও রওশনকেই বেছে নেয়া হয় বলে জাপা নেতারা বলছেন।
গত বছরের নভেম্বরে জাতীয় পার্টির ১০ম জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন এরশাদ। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রওশনের এই উদ্যোগে জি এম কাদেরের সাথে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। ওই সময় সংসদীয় কমিটির সভা ডেকে বেশির ভাগ এমপির স্বাক্ষর নিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচন করে স্পিকারকে চিঠি দেয়া হয়। দেবর-ভাবীর মধ্যে বেশ কিছুদিন দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদপন্থীরা কাউন্সিল স্থগিত ঘোষণা করেন।
তবে, সম্প্রতি ফের রওশনপন্থীরা আবারো সক্রিয়া ভূমিকায় রয়েছেন। গত রোববার রাজধানীর গুলশানে বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ বলেন, গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে বেগম রওশন এরশাদের সাক্ষাতকে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। জাতীয় পার্টি গণতন্ত্র বিশ্বাস করে এবং একটি নির্বাচনীমুখী দল। আর সেই কারণে আগামী কয়েকটি মাস আমাদের জন্য খুবই গুরুত্ব বহন করে। বিরোধী দলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশীদ বলেন, শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় পার্টির দশম জাতীয় সম্মেলন। আর এর পরপরই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই এই দু’টি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখনই আপনাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহী সাদ এরশাদ এমপি। আরো বক্তব্য রাখেন জাপা নেতা অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙা, কারী হাবিবউল্লাহ বেলালী, সাবেক এমপি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, এমএ গোফরান, রফিকুল হক হাফিজ, সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা, জাপা নেতা ফখর উজ্জামান জাহাঙ্গীর,অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, সাবেক এমপি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন প্রমুখ।