জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে আগামী মাসে দিল্লি সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই সফরের সময় ভারত তাকে দু’টি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারে। এগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে সব চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বেছে নিতে হবে। আনন্দবাজার গ্রুপের আরেকটি পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ এই খবর দিয়েছে। তিন দিন আগে আনন্দবাজার ‘হাসিনাকে দুর্বল করলে ক্ষতি সবার, বার্তা আমেরিকাকে’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। যা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এই প্রতিক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই দ্য টেলিগ্রাফ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে খবর দিয়েছে। আনন্দবাজারের রিপোর্টের সাথে এই রিপোর্টের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে।
খবরে বলা হয়, শেখ হাসিনার প্রতি এই জোড়া বার্তা প্রসঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা এস্টাব্লিশমেন্টের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই ঘটনা বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের বিষয়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্যের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের (ভারত ও মার্কিন) নিরাপত্তাবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে।
এসব বৈঠক হয়েছে ভারত ও এই অঞ্চলের অন্য কয়েকটি দেশে। অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য ছিল। তবে এবার দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জি-২০ সম্মেলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে থাকবেন তখন তাকে এই দু’টি বার্তা দেয়া হবে।
যদিও শেখ হাসিনা দাবি করে আসছেন যে, তার অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ নয়াদিল্লি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৯৬ শতাংশের বেশি আসনে জয় পাওয়ার পর শেখ হাসিনাকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অর্থাৎ, নির্বাচনের ফলাফল যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে থাকবে ততক্ষণ ভারত এর সুষ্ঠুতা নিয়ে চিন্তা করবে না। শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লি সর্বদা তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে।
ঢাকার এক কৌশলগত সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বলেন, শেখ হাসিনা এখনো ভারতের প্রিয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নয়াদিল্লির এসব উদ্বেগের সমাধান না হলে ভারত এবারো শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাবে এমনটা না-ও হতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের অনেকগুলো ইচ্ছা পূরণ করেছে। এর মধ্যে আছে, ইসলামপন্থীদের দমন এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য চলাচলের অনুমতি দেয়া। তবে নয়াদিল্লির জন্য এখন সব থেকে বড় উদ্বেগ হলো- চীনের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠতা। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই একটি ফ্যাক্টরই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার আলোচনা নিয়ে সূত্রগুলো আরো যা জানিয়েছে তা নিচে উল্লেখ করা হলো-
উভয় দেশই বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোতে (সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে) চীনপন্থী এবং ইসলামপন্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অবিলম্বে এই অবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে দেশ দু’টি। দিল্লি সফরের সময়ে শেখ হাসিনার কাছে এ নিয়ে উদ্বেগ জানাতে সম্মত হয়েছে ভারত।
উভয় পক্ষই দ্ব্যর্থহীনভাবে একমত হয়েছে যে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। হাসিনার সফরে ভারত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মত হয়েছে যে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রশ্নই উঠে না, কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। যদিও বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলের অন্যতম প্রধান দাবি এটি।
উভয় পক্ষে সম্পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে যে, হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি এবং ব্যাংক খেলাপিদের দমন করার জন্য দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটি মোকাবেলা করতে হবে যা সাধারণ বাংলাদেশীদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা মার্কিন কর্মকর্তাদের বুঝিয়েছেন যে, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার যে এজেন্ডা যুক্তরাষ্ট্র হাতে নিয়েছে তা দেশের ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোটকে নিয়ে আসবে। এতে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে এবং ভারতের নিরাপত্তা হুমকি বৃদ্ধি পাবে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে জামায়াত-ই-ইসলামিকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে তা নিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা আপত্তি জানিয়েছেন। উলটো জামায়াতকে একটি মৌলবাদী সংগঠন বলে তুলে ধরেছে ভারত।
নয়াদিল্লির প্রতিনিধিরা মার্কিন কর্মকর্তাদের বলেছেন যে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জো বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে এ নিয়ে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত।
অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থানে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। তবে সূত্রগুলো বলছে, শুধু সে কারণেই এবারের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঢাকা থেকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে। ফলে রাজনীতিতে অনাগ্রহী তরুণ প্রজন্ম দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে উৎসাহিত হবে। আবার ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য দিয়ে নয় বরঞ্চ জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করলে তা আওয়ামী লীগকেও শক্তিশালী করবে। সর্বশেষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এখন সবথেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা এই পরামর্শগুলো মানবেন কি না।