২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন এবং তাদের পক্ষে আইনজীবীদের করা আপিলের ওপর শুনানি শেষ করে চলতি বছরের মধ্যেই রায় প্রত্যাশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, মামলার পেপারবুক পড়া শেষদিকে। পেপারবুক পড়া শেষে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১০-১২ কার্যদিবস শুনানি লাগতে পারে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে কতদিন লাগতে পারে, তা নির্ভর করে আদালতের ওপর।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারকার্য শেষে পাঁচ বছর আগে রায় হয়। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল শুনানি শুরু হয়। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি চলছে।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ এখন নিম্ন আদালতের ৩ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক নিয়ে কাজ করছে যেখানে মামলার বিস্তারিত রয়েছে। আমরা আশা করছি, ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য মামলা প্রস্তুত করতে মাত্র একদিন শুনানির পর বাকি পৃষ্ঠাগুলো পড়া শেষ হবে। তিনি বলেন, দুই সদস্যের হাইকোর্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতির অসুস্থতার কারণে মামলার শুনানি আংশিকভাবে বিলম্বিত হয়, তবে আশা করা যায় একবার বেঞ্চ পুনরায় শুনানি শুরু করলে বেশি সময় লাগবে না। আমি মনে করি মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের ১০ থেকে ১২টি শুনানি লাগতে পারে। রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, আমার ধারণা, চলতি অক্টোবরের মধ্যে হাইকোর্টের রিভিউ শেষ হতে পারে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলার রায় দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।
এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা পুরো রায়টি দেখেছি (নিম্ন আদালতের রায়), এটি যথার্থ বলে মনে হয়েছে। আমরা আইনের পয়েন্টগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করার পর নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার জন্য আবেদন করব। তিনি বলেন, এখানে প্রকৃতপক্ষে দুটি মামলা রয়েছে- একটি খুনের, অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের। দুটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চক্রান্তকারীরা সেই নজিরবিহীন আক্রমণের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল।
এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির আমাদের সময়কে বলেন, পেপারবুক পড়া শেষ হলে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হবে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ জবাব দেবে। তিনি বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে আদালত যেভাবে কার্যসূচি নির্ধারণ করবেন সেভাবেই তা হবে।
এই আইনজীবী বলেন, এ মামলায় যারা ভিকটিম, তারা বিচার পায়নি। যারা আসামিপক্ষ তারাও বিচার পায়নি। এর কারণ হলো- সঠিক তদন্ত করে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, এমন নজির ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মাঝখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ। শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।
ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন। মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণ চলাকালে শেখ হাসিনার চারপাশে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান তিনি। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচ- শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়। সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।