দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে আবারও হতাশা ভর করেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর মধ্যেই এখন শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। তবে শেয়ারের দাম সর্বনিম্ন স্তরে (ফ্লোর প্রাইসে) আটকে থাকায় তারা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে গত কয়েক দিনে লেনদেন তলানিতে নেমেছে। আর বিক্রির চাপে লেনদেন হওয়া বেশিরভাগ শেয়ারের দরপতন ঘটছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও পাঁচ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। এ অবস্থায় গতকাল পুঁজিবাজারের অংশীজনদের (স্টেকহোল্ডার) নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পূবর্ নির্ধারিত একটি বৈঠকের খবরে বাজারে সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানা গেছে, বৈঠক দুটিতে সংকট উত্তরণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এবং মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করা এবং এর প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পুঁজিবারবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
বলছেন, সাম্প্রতিক মন্দাভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা তৈরি করেছে। এ কারণে তারা আরও লোকসানের ভয়ে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন। এভাবে বিক্রির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে ক্রেতাসংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে নতুন করে কেউ বিনিয়োগে আসছেন না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, নানা কারণে পুঁজিবাজার এ গতিহীনতা চলছে। ফলে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে বাজারে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা, সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি ইত্যাদি কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র উদ্বেগ। নানামুখী গুজব এ উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পুঁজিবাজারের বাতাসে রীতিমতো গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে, যাতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে লেনদেন তলানিতে নামা।
শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীরাও একই কথা জানান। তারা বলেন, বিনিয়োগকারীদের মনে এখন চরম হতাশা ভর করছে। অনেকে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি (পেনিক সেল) করছে। তারা আরও জানান, বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর একটি বড় অংশই ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। সেসব শেয়ার লেনদেনের সুযোগ পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। তাই যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের ওপরে আছে, সেগুলো বিক্রি করে দিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন তারা। কারণ এসব শেয়ারও ফ্লোর প্রাইসে আটকে গেলে তখন আর বিক্রি করতে পারবেন না এমন আশঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২৯৯ কোটি ৫২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে গত ২৮ মার্চ ডিএসইতে ২৭২ কোটি ৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। ডিএসইতে গতকাল আগের দিন থেকে ৫২ কোটি টাকা কম লেনদেন হয়েছে। বুধবার ডিএসইতে ৩৫১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।
অন্যদিকে বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বৈঠকের খবরে ডিএসইপ্রধান বা ডিএসইএক্স সূচক ৩৪ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২৫৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরিয়াহ সূচক ৭ পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ৩৫৮ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ১৩ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ১২১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে ৩২১ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৫৩টির, কমেছে ৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৬০টির।
ডিএসইর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী আমাদের সময়কে বলেন, বাজারে ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রায় ৬৪ শতাংশ শেয়ার আটকে আছে। এতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ২০ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে সেল পেশার ছিল। পাশাপাশি কিছু রিউমারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। তবে গতকাল স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠকের খবরে বাজারে সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াবে বাণিজ্যিক ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো। গতকাল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, বন্ড মার্কেট ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে করণীয় সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সভায় এ তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন, শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান, ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছায়েদুর রহমান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহিত রহমান, সিটি ব্যাংকের এএমডি ও সিএফও মো মাহবুবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সবাইকে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বন্ড মার্কেট বিশ্বজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জোগানে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং বাংলাদেশের বাজারেও এর জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা। দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বন্ড বাজারকে আরও টেকসই রূপ দেওয়া এবং বন্ডের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া বৈঠকে বন্ড ইস্যুর প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান নানা সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং এ প্রক্রিয়ার সহজীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়। বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনের কারণ এবং বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে সভায় সবাই মতামত দেন।
সভায় আলোচকরা বলেন, দেশের পুঁজিবাজারে শক্তিশালী বন্ডের বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে হবে। এ ছাড়া বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অর্থায়নের সুযোগ কাজে লাগাতে সচেতন ও আগ্রহী করতে কাজ করতে হবে। দেশে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য বন্ড বাজার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বিএসইসি। করপোরেট বন্ডের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব গ্রিন বন্ড, ব্লু বন্ড ইত্যাদি টেকসই বন্ড নিয়ে আসার পরিকল্পনায় কাজ চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বন্ড নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও নীতিগত উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে বিএসইসি।
গতকাল সভায় বিএসইসি আরও জানিয়েছে, দেশের বন্ড বাজারের উন্নয়নে সরকার সহায়ক ভূমিকায় রয়েছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া গতকাল অ্যাসেট ম্যানেজার এবং ফান্ড ম্যানেজারদের সঙ্গে বিএসইসির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিএসইসির কমিশনার ড. মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সভায় বর্তমান বাজার পরিস্থিতিসহ দেশের পুঁজিবাজারে বিদ্যমান মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নয়ন এবং পুঁজিবাজার বিনিয়োগের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। কমিশনার মিজানুর রহমান উপস্থিত ফান্ড ম্যানেজার ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা করে এবং সুষ্ঠু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা দেন।