২০০৫ সালের এই দিনে (১৭ আগস্ট) দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা করেছিল জঙ্গিরা। সেই ঘটনার দেড় যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও সেই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার শেষ হয়নি। উল্টো ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা করেছিল যেই জঙ্গি সংগঠন, সেই জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবির তৎপরতাও বন্ধ হয়নি। কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও জেএমবি এখনও তৎপর রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আত্মগোপন করে জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে শাইখ সালাউদ্দিন সালেহীন। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা করে সালাউদ্দিন সালেহীনসহ তিন জঙ্গি নেতাকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। ওই দিন রাতেই একজন ক্রসফায়ারে নিহত ও পরবর্তীতে একজন ভারতে গ্রেফতার হলেও সালেহীনকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় দুই জন নিহতসহ আহত হয়েছিলেন ১০৪ জন। একযোগে হামলার মাধ্যমে দেশে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির ঘোষণা করেছিল জঙ্গিরা। হামলার সময় জেএমবির পক্ষ থেকে একটি লিফলেটও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও ১৯৯৮ সালে কার্যক্রম শুরু করা জেএমবি হামলা শুরু করে ২০০১ সাল থেকে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ওই ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৪২টি মামলায় অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ও ১৭টি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে এসব মামলায় ১ হাজার ১৩১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় তদন্ত কর্মকর্তারা। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ২৩ জঙ্গিকে। বিগত ১৮ বছরে ১১৮টি মামলার রায় হয়েছে। এসব রায়ে বিভিন্ন মেয়াদে ৩২২ জনকে সাজা দেন আদালত। খালাস পেয়েছে ৩৫৮ জন। জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান, শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানিসহ ১৫ শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিরিজ বোমা হামলার দেড় যুগ পার হলেও এখনও ৪১ মামলার বিচার শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভাষ্য, সাক্ষী না পেয়ে গত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু মামলার কার্যক্রম থমকে আছে। সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে এসব মামলায় বিচার শেষ হচ্ছে না। আবার বিভিন্ন বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও শতাধিক জঙ্গির করা আপিল শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে।
ঢাকা মহানগর আদালত সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর এলাকায় ওই বোমা হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলা দায়ের হয়। এই ১৮টি মামলায় পুলিশ ও র্যাব ৯১ জনকে গ্রেফতার করে। ৫৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দেয়। ১৪টি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হলেও বর্তমানে ৪টি মামলা বিচারাধীন আছে। এগুলো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিচারাধীন মামলাগুলোতে যারা সাক্ষী ছিলেন তাদের অনেককে আগের সেই ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে মারা গেছেন, কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এ জন্য পুরনো এসব মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনও তৎপর জেএমবি
শায়খ আব্দুর রহমানের হাত ধরে ১৯৯৮ সালে গঠিত হওয়া জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবি এখনও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শুরুর দিকে নিষিদ্ধ এই সংগঠনটি বাংলাদেশের ছয়টি অঞ্চলকে ভাগ করে তাদের কার্যক্রম আরম্ভ করে। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দুই বছর দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে কর্মী সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন এনজিওতে ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ শুরু করে। ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তারা সাতক্ষীরার একটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে। পরের বছর ২০০২ সালের পয়লা মে নাটোরের আরেকটি সিনেমা হলে এবং ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা চালায়। একই সঙ্গে জেএমবির শীর্ষ নেতা বাংলা ভাই রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় চরমপন্থি নিধনের নামে ব্যাপক হত্যা-নির্যাতন চালায়।
জঙ্গি প্রতিরোধে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, জেএমবির উত্থানের সময় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলার পর নড়েচড়ে বসে তৎকালীন সরকার। সে সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে। কিন্তু তারপরও গোপনে গোপনে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। মাওলানা সাইদুর রহমানকে ঘোষণা করা হয় নতুন আমির। ২০১০ সালে মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবির নেতৃত্ব নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে একটি পক্ষ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের অনুসারী হয়ে নিও জেএমবি গঠন করে। ওই বছরেরই ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির শীর্ষ তিন নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন, মিজানুর রহমান ওরফে বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদকে ছিনিয়ে নেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ওই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ওই দিন রাতেই টাঙ্গাইলে হাফেজ মাহমুদ পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। সালেহীন ও বোমা মিজান পালিয়ে চলে যায় ভারতে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ভারতে গ্রেফতার হয় বোমা মিজান। কিন্তু এখনও আত্মগোপনে রয়েছে সালাউদ্দিন সালেহীন। ২০১৪ সাল থেকে সালেহীন পুরনো জেএমবির আমির হিসেবে সংগঠনকে পুনর্গঠিত করার কাজ করছে।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সালেহীন পুরনো সঙ্গীদের নিয়ে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছিল। রেজাউল হক নামে একজনকে দেশে কার্যক্রম চালানোর জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল। ২০২১ সালে সেই রেজাউল হককে গ্রেফতার করা হয়। তবে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ
জঙ্গি প্রতিরোধে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিত অনুদান পেলেও ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ করতো জেএমবি। তাদের ভাষ্য, ডাকাতি করা অর্থের একটি অংশ সংগঠনের তহবিলে দান করতে হতো। বিভিন্ন সময়ে এনজিও প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করলেও ২০১৫ সালে আশুলিয়ায় একটি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে জেএমবি। সর্বশেষ ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েও এর নেপথ্যে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, জেএমবির সদস্য যারা জেলে বন্দি রয়েছেন, তারা পেশাদার চোর-ডাকাতদের মোটিভেট করে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে যৌথভাবে ডাকাতি করার তথ্য পেয়েছিলেন। এমনকি জেলে বসেই শীর্ষ এক জঙ্গি সদস্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কাদের বাসায় ডাকাতি করা তাদের ভাষায় জায়েজ, সেই অডিও উদ্ধার করেছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে বিদেশি অনুদান কমে আসার কারণে মাসিক চাঁদা বা ইয়ানত ও ডাকাতিসহ অন্যান্যভাবে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে জেএমবি। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে জেএমবি বর্তমানে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার এস এম নাজমুল হক বলেন, আমাদের অভিযানের কারণে পুরনো জেএমবি কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। আত্মগোপনে থেকে সালেহীন সংগঠনকে পুনগর্ঠিত করার চেষ্টা করছে। উত্তরবঙ্গ কেন্দ্রিক তাদের কিছু তৎপরতা রয়েছে। আমরা তাদের নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রেখেছি।