জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হাসপাতালটির ভেতরে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রোগীর স্বজনরা।
তাদের দাবি, পুলিশের টিয়ারগ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে অনেকেরই ঘুম ভেঙে যায়। গ্যাসে ধোঁয়ায় রোগীদেরও শ্বাসকষ্টের অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এমনকি এক রোগীর স্বজন জানান, অনবরত বিকট শব্দ শুনে ভয়ে তার হার্ট অ্যাটাকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লক এবং ডি ব্লকে অবস্থানরত রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, মঙ্গলবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে মরদেহবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে সাঈদীকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে ভোর ৫টার দিকে সাঈদীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এসময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের তাণ্ডবের অভিযোগে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। একপর্যায়ে টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
বাইরে যখন পুলিশ-জামায়াত কর্মীরা মুখোমুখি অবস্থানের কারণে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখন রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে হাসপাতালের বারান্দায় এসে নিজেও ঘুমাচ্ছিলেন কিশোরগঞ্জ থেকে আসা খায়রুল ইসলাম। পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ঘুমিয়ে গেছিলাম, বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে। তারপর জানালা দিয়ে দেখতে গেলাম কী হয়েছে। গিয়ে দেখি টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। পরে দৌড়ে আবার চলে আসি। একটা পর্যায়ে ধোঁয়া ওয়ার্ডের ভেতরেও চলে আসে। এতে করে রোগী ও স্বজনদেরও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
খায়রুল ইসলাম বলেন, বারবার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসারকে বলছিলাম গেট লাগিয়ে দিতে, কিন্তু তারা নিজেরাই ভয়ে দরজা লাগিয়ে রুমের ভেতরে বসে ছিল। ভয়ে একটা থমথমে অবস্থা তখন। আল্লাহ-আল্লাহ করে রাতটা শেষ হয়েছে।
মাদারীপুর থেকে আসা রোগীর স্বজন নজরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ওয়ার্ডেও ঢুকে গিয়েছিল। বাইরে যখন তারা গ্যাসের কারণে টিকতে পারছিল না, তখন ভেতরে এসে তারা আশ্রয় নিতে থাকে। আমরা যারা রোগী এবং রোগীর স্বজনরা ছিলাম, আমরা চেষ্টা করেছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে।
তিনি বলেন, রাতের এতোটাই ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল যে সে পরিস্থিতিতে আনসার সদস্যরাও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অনেক রোগী এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজন ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল।
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আসা রোগীর স্বজন আলী আহমদ বলেন, বাইরে ঠুসঠাস শব্দ শুনে গেটের কাছে গিয়েছিলাম একনজর দেখতে, গিয়ে দেখি বিভিন্ন দিক থেকে ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশও গুলি ছুড়ছে। এরপর বাইরে থেকে দৌড়ে ওয়ার্ডে চলে আসি।
তিনি আরও বলেন, একটা হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের রোগী থাকে, হাসপাতালের ভেতর যদি এমন অবস্থা তৈরি হয়, সাধারণ মানুষই তো ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করবে। রোগীর অবস্থা তো আরও খারাপ হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তা কর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতে ডিউটি শেষ করে পাশেই বেতার ভবনে গেলাম বিশ্রাম করতে। কিন্তু বাইরে আন্দোলন, চিৎকার, স্লোগানে আর ভেতরে থাকতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে নিজেই একটু দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু টিয়ারগ্যাস মারার পর সেখান থেকে কোনরকমে চলে এসেছি।
জামায়াত কর্মীরা ভাঙচুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশসহ নিরাপত্তাবাহিনীর কারণে এতোটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে সকালে যখন ৬টার দিকে ডিউটিতে এসেছি, তখন প্রচুর ইটপাটকেল, ভাঙা কাচ হাসপাতালের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
এসব প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রি. জে. ডা. রেজাউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবে সেটি এখন অনুমান করে বলা যাচ্ছে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে বসবো, ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করে আগামীকাল আপনাদের আমরা জানাবো।
সুনির্দিষ্ট কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি আমাদের হয়নি। তবে অক্সিজেন প্লান্টটা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও কিছু স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। কিছু জানালার গ্লাস ভেঙেছে। এর বাইরে হাসপাতালের ভেতরে থাকা একজন জেলা ডিসির গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। এর বাইরে প্রথমে যে অ্যাম্বুলেন্সটাতে লাশ তোলা হয়েছিল, সেটার চাকাসহ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও কিছু ভাঙচুর করা হয়েছে।