টঙ্গী প্রতিনিধি: টঙ্গীতে আলোচিত শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনার ৪৫ দিন পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে পুলিশ। গত ২৫ জুন রাতে শ্রমিকনেতা শহিদুলের মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হলে তিনি জ্ঞান হারান। পরে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় তাঁর।
শ্রমিকনেতার মাথার পেছনের অংশের একটি হাড় ভেঙে যাওয়া ও রক্তক্ষরণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তৈরি করেছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের (মেডিসিন) ডা. এএনএমএল আল মামুন রোমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘শহিদুলের মাথায় কোনো শক্ত কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়েছে। এতে তাঁর মাথার পেছনের অংশে ঘাড়ের একটু ওপরে একটি হাড় ভেঙে যায়। সেখান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। বুধবার আমরা মামলার দায়িত্বে থাকা শিল্প পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, শুরুর দিকে শহিদুল হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন এমন বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁর হৃৎপিন্ড সংগ্রহ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে জানা যায় শহিদুলের হার্টে কোনো সমস্যা ছিল না, তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যাননি। পুলিশের করা সুরতহাল রিপোর্টেও তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পায়নি পুলিশ।
গত ২৫ জুন রাতে টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকার প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড কারখানায় বেতন ভাতার দাবিতে শ্র্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। এ সময় দুইটি শ্রমিক সংগঠন ও মালিক পক্ষের কয়েকজনের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটলে অসুস্থ হয়ে পড়েন শহিদুল। পরে তাঁকে গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার তায়রুন্নেসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার রাতেই টঙ্গী পশ্চিম থানা-পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) উৎপল কুমার হাসপাতালে গিয়ে লাশটির সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন ২৬ জুন লাশের ভিসেরা সংগ্রহ করে ঢাকার সিআইডি কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
ঘটনার পরদিন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত সাতজনকে আসামি করে টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর পুলিশ এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি মাজাহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। মাজাহারুল বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদকের পদে দায়িত্ব পালন করতেন।
মামলা দায়েরের পর টঙ্গী পশ্চিম থানা-পুলিশের প্রতি তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে আদালতে লিখিত আবেদন জানান মামলাটির বাদী পক্ষের আইনজীবী। এদিকে প্রথমে মামলাটির তদন্ত করে টঙ্গী পশ্চিম থানা-পুলিশ। পরে আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে ১০ দিন পর (৬ জুলাই) মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় গাজীপুর জেলা শিল্প পুলিশকে। আর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক (টঙ্গী জোন) ওসমান গনি। এরই মধ্যে ভিসেরা ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় পেরিয়ে গেছে ৪৫ দিন।
অপরদিকে নিহত শহিদুলের স্ত্রী কাজলি বেগম বলেন, ‘আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। আমার দুইটি ছেলে সন্তান রয়েছে। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। আমার চিকিৎসাতে এক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমি অসুস্থ তাই মামলাটির বাদী হইনি। আজ আমাকে জানানো হয়েছে আমার স্বামীকে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলা হয়েছে।’
মামলার বাদী কল্পনা আক্তার বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর এ পর্যন্ত পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করার খবর আমাকে জানিয়েছে। আমরা শহিদুলের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ রাখছি। একটি সামাজিক সংগঠন শহিদুলের অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছে। তবে আমাদের একটি বিষয়ে ভুল হয়েছে, যা আমাদের জানা ছিল না। টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসির কথায় আমরা এজাহারে অন্যতম আসামি ম্যানেজার হালিমের স্থলে হানিফের নাম উল্লেখ করেছি। আজ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পুলিশ পেয়েছে। এ বিষয়ে আমাকে ফোনে জানানো হয়েছে।’
টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মো. শাহ আলম বলেন, মামলাটি শিল্প পুলিশ তদন্ত করছে। মামলায় আসামির নাম ভুল হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাদী এজাহারে যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা নেওয়া হয়েছে।
মামলাটির তদারকি কর্মকর্তা গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইমরান আহম্মেদ বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ের তদন্তে আমরা অনেকটাই নিশ্চিত ছিলাম শহিদুলকে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে আরও নিশ্চিত হয়েছি। এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন ভিন্নভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শহিদুলের মৃত্যুর কারণ আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি। এখন হামলাকারী ও ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে পুলিশ।’