বারো দিন বিরতি দিয়ে আবারও সরকার পতনে একদফা দাবিতে রাজপথে ফিরছে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে অতিবৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়া এবং কোথাও কোথাও বন্যা দেখা দেওয়ায় রাজধানীর বাইরে কোনো কর্মসূচি রাখা হচ্ছে না। আগামী ১১ আগস্ট ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, শিগগিরই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন কর্মসূচি গ্রহণের পর বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবারই সমমনা দলগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি। ১২-দলীয় জোট নেতা সৈয়দ এহসানুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, ১১ আগস্টের কর্মসূচি বিএনপি আমাদের জানিয়েছে।
গত ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ ও পর দিন ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এর পরই
আন্দোলনে বিরতি দেওয়া হয়। পরে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ফের কর্মসূচি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়াও গত ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। সম্প্রতি বিচারিক আদালতে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের দ- দেওয়াকে জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা মনে করছে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত জানাতে গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, একদফা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বয় করে কর্মসূচি প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন ধরে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার সঙ্গে স্কাইপে কথা বলেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকসহ অন্য অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপিকে আন্দোলনে এগিয়ে রেখেছে। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে বিএনপি একেবারে সফলতা দেখাতে পারেনি।
গত সোমবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, নেতারা মনে করেন, অবস্থান কর্মসূচি বিএনপিকে সাংগঠনিক দুর্বলতা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনও সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। যাদেরও ওপর সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল তারা কাজ সঠিকভাবে করতে পারেনি। ফলে যেভাবে কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি।
এদিকে বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, সরকারের মনোভাব তত কঠোর হবে। এমন পরিস্থিতিতে রাজপথে আন্দোলন জোরদারে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে একত্রিত করতে চাইছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই ভাবনা থেকে জামায়াতে ইসলামীসহ সরকারবিরোধী ডান, বাম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ফলও আসতে শুরু করেছে। গত রবিবার বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) যুগপৎ আন্দোলনে থাকার ঘোষণাও দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও সম্প্রতি বৈঠক করেছে বিএনপি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আমাদের সময়কে বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজপথে থাকবে।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, বিএনপির আন্দোলন পরিকল্পনা অনুযায়ী ধাপে ধাপে এগোচ্ছে। নেতারা মনে করেন, অবস্থান কর্মসূচি থেকে দল যা অর্জন করেছে, তা আগামী দিনের আন্দোলনে সহায়ক হিসেবে কাজে দেবে। বিশেষ করে, পুলিশের কঠোর মনোভাব দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ভালোভাবে নেয়নি। পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস-সহিংসতা’ সৃষ্টির যে অভিযোগ সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন সময়ে করা হয়, তাও এ অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে দূর করা গেছে বলে মনে করেন বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের নেতা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে সরকার পতনের চলমান আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এই আন্দোলন এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে।
‘শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়’Ñ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া দলগুলোকে এবার রাজপথে নামাতে চাইছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এই চিন্তা থেকে যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার ফেরাতে আমরা সবাইকে রাজপথে দেখতে চাই। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে অনেকের কথাবার্তা চলছে। ডান-বামসহ সব রাজনৈতিক দলকেই আমরা চলমান আন্দোলনে নিয়ে যেতে চাই।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ীরা এমপি হিসেবে শপথ ও জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়ার প্রতিবাদ করে ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। সেই বিজেপিও গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে সরকার পতনের একদফাকে সমর্থন করে যুগপৎ আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। বিএনপির এক নেতা বলেন, ভিন্ন দাবি নিয়ে খুব শিগগির এরশাদের জাতীয় পার্টিও রাজপথে নামবে। পরিস্থিতি তৈরি করা গেলে জাতীয় পার্টিও সরকার পতন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির পক্ষ থেকে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। বরিশাল অঞ্চলের সাবেক একজন সংসদ সদস্য দলের শীর্ষ নেতার নির্দেশে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করছেন। বাম ধারা থেকে বিএনপিতে আসা নেতারা নানা মাধ্যমে কথা বলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন। বিএনপি নেতারা মনে করেন, সিপিবি সম্পর্কে তাদের ধারণা, এই মুহূর্তে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে তারাও রাজপথে সোচ্চার।