‘রাস্তায় বোমা পুঁতে রাখে। বন্ধ হয়ে গেছে শিশুদের স্কুলে যাওয়া। ঘরের বাইরে যেতে ভয়। প্রতিবাদে মুখ খুললে জীবন শেষ। চাঁদা না দিলে তুলে নিয়ে যাবে, প্রতিক্ষণ সেই ভয়। দিন-রাত কাটছে ভয় আর আতঙ্কে। কুকি-চিনের কারণে এখন আমরা ভীষণ অসহায়।’
এভাবে পাহাড়ের পরিস্থিতি জানাচ্ছিলেন যিনি, তার বয়স চল্লিশের কোটা পেরিয়ে গেছে। ভয়ে নাম প্রকাশ করতে নারাজ। গত বুধবার বিকালে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল বান্দরবানের রুমা উপজেলার বগা লেকপাড়ায়। পার্বত্য এই জেলাটিতে সম্প্রতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। তাদের খুন, অপহরণ, নৃশংস কর্মকা-ের কারণে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানির কাছে পাহাড়বাসী রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছে।
মূলত বম সম্প্রদায়ের লোকেরা কেএনএফ গড়ে তুলেছে বলে মনে করা হয়। বগা লেক বমপাড়ারও কয়েক বাসিন্দা এই সন্ত্রাসী দলে যোগ দিয়েছেন বলে জানান ওই ব্যক্তি।
কেএনএফ সন্ত্রাসী দলের তৎপরতায় বান্দরবানের পাহাড়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের পরতে পরতে এখন লুকিয়ে আছে আতঙ্ক। ফলে চাষাবাদ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যটন ও মালামাল পরিবহনসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বগা লেকপাড়ার গির্জার সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয় হোটেল ও কটেজ ব্যবসায়ী লালরামচহ বম লারামকে (৪৩)। ৫ দিন পর পাহাড়ের খাদে তার লাশের দেখা মেলে। এ হত্যাকা- কেএনএফ ঘটিয়েছে বলে জানান রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন। তিনি জানান, এ কা-ে ৪ থেকে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রুমা উপজেলার বগা লেকপাড়ার প্রধান (কারবারি) রিয়েল মনথন বোম আমাদের সময়কে জানান, কেএনএফের কোনো সদস্য গ্রামে থাকে না। তারা সুযোগমতো মানুষ, দোকান ও গাড়ি থেকে চাঁদা নিয়ে আবার আস্তানায় ফিরে যায়।
বগা লেখপাড়া থেকে বান্দরবান সদরের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। পাহাড়ি
আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পথ বেয়ে বগা লেক থেকে সদর উপজেলার চিম্বুক পাহাড়ের লাইমিপাড়ায় আসতে গাড়িতে সময় লাগে প্রায় ৬ ঘণ্টা। দুই পাড়ার দূরত্ব অনেক হলেও সমস্যা ভয় ও আতঙ্ক প্রায় একই রকম। লাইমিপাড়ার বাসিন্দা প্রায় ৪৩৪ জন। পাড়াটি বম সম্প্রদায়ের।
গত মঙ্গলবার দুপুরে পাড়াটির অন্তত সাত বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে আমাদের সময়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব বাসিন্দা বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে শিশুদের পড়ালেখা থেকে শুরু করে চলাফেরা সবই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাহাড়ের শান্তি না ফিরলে না খেয়ে মরতে হবে।
পাড়ার প্রধান (কারবারি) লালী লেন বম আমাদের সময়কে জানান, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য এক বছর ধরে পর্যটন বন্ধ হয়ে গেছে। দোকান থাকলেও কেনাবেচা নেই।
পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপরও কেএনএফ সন্ত্রাসীরা অত্যাচার চালায় বলে জানান পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মো. শাহজালাল। তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের ভয়ে ঠিকাদার কাজ করতে সাহস করছেন না। এনজিও কর্মকা-ও বন্ধ। ফলে পর্যটন, কৃষিসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, কেএনএফের প্রধান নাথান লনচেও বম (৫০)। নিজেদের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছে তারা। এই আলাদা রাজ্যের মানচিত্রে রয়েছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ আশপাশের ১১টি উপজেলা। এই পেজে দাবি করা হয়, কেএনএফ সংগঠনটি বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং ও খুমিসহ ছয় জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। সেখানে জানানো হয়, কেএনএফের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য প্রায় তিন বছর আগে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে ২০২১ সালে একটি দল ফিরেও এসেছে। বম সম্প্রদায়ের একটি অংশ উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়লেও তাদের ফেরানোর চেষ্টা রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। বম সম্প্রদায়ের সোস্যাল কাউন্সিলের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
কেএনএফের শীর্ষনেতা নাথান বমসহ অন্য নেতারা প্রতিবেশী দেশে আত্মগোপনে রয়েছে বলে মনে করেন এলিট ফোর্স র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কেএনএফের আর কোনো আস্তানা বা ঘাঁটি থাকার তথ্য আপাতত আমাদের জানা নেই। অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব ফোর্সেসও পাহাড়ের এসব এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে কেএনএফ ও তাদের আশ্রয়ে থাকা জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। এরপর কেএনএফ সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলা ও গুপ্ত বোমা (আইইডি) বিস্ফোরণে অন্তত পাঁচ সেনাসদস্য নিহত ও ১১ সেনাসদস্য আহত হয়েছেন। এর বাইরেও পাহাড়ের আধিপত্য ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে অন্যান্য আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা দলের হামলায় কেএনএফের ১৭ জন নিহত এবং দুজন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে জেএসএস (মূল) দলের সঙ্গে গোলাগুলিতে ছয়জন এবং ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) দলের সঙ্গে গোলাগুলিতে কেএনএফের ১১ জন নিহত হয়েছেন।
যেভাবে অস্ত্রধারী কুকি-চিন : পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ বম সম্প্রদায়। তাদের শিক্ষার হার কম। পাহাড়ের উঁচুতে বসবাস করায় তারা চাইলেই শিক্ষার সুযোগ পান না। সুযোগ-সুবিধা না মেলায় দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য অঞ্চলের বম, লুসাই, পাংখুয়ার মতো পিছিয়ে পড়া উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিন দিন তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাদের প্রতিবাদের টার্গেটেই ছিল চাকমা মারমা নেতৃত্বাধীন জেএসএস এবং প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ।
রহস্যজনক নীরবতা অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর : দেশের বিরুদ্ধে কেএনএফ ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেতারাও রহস্যজনক কারণে নীরব আছেন। স্থানীয়রা বলছেন, স্থানীয় কমিউনিটি কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আওয়াজ তোলে না। দীর্ঘদিন পর্যটন বন্ধ থাকার পরও তারা দু-একটি বিবৃতি ছাড়া কোনো কার্যক্রম করে না। হোটেল-মোটেলসহ যেসব পেশাজীবী সমিতি বান্দরবানে আছে, তারা কোনো বিবৃতি পর্যন্ত দেয় না। স্থানীয় কমিউনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সন্ত্রাস পুরোপুরি দমন সম্ভব নয়।
স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, পার্বত্য অঞ্চলের সবার প্রতিনিধি হিসেবে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) শান্তি চুক্তি করেছিল সরকারের সঙ্গে। এখন বম সম্প্রদায় কিংবা কুকি-চিন তো আর পার্বত্য এলাকার বাইরে না। তা হলে চুক্তির শর্ত না মেনে কুকি-চিন অস্ত্র তুলে নিলে জেএসএসের প্রতিবাদ করা উচিত। প্রতিবাদ না করার কারণ হিসেবে জানা যায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভয়ে প্রতিবাদ করে না। আবার কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন তাদের প্রতি রয়েছে।
চাঁদার টাকায় অস্ত্র কেনে কেএনএফ : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় প্রশাসন ও পাহাড়ি বাসিন্দাদের কয়েকজন জানান, প্রতি মাসে নিয়মিত বিভিন্ন পাড়া, দোকান, রেস্টুরেন্ট ও কটেজসহ যানবাহন থেকে চাঁদা উঠাচ্ছে কুকি-চিনের সন্ত্রাসীরা। অনেক বম পরিবারের সদস্যরা কেএনএফের সদস্য হিসেবে সক্রিয় আছেন। ফলে ইউনিফর্ম ছেড়ে বা অস্ত্র লুকিয়ে রেখে এসে বাড়িতে নির্বিঘেœ অবস্থান করছেন কেউ কেউ। এরপর চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে তারা আবার পাহাড়ে চলে যান। এসব টাকায় ভারী অস্ত্র কেনে তারা। বম সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষগুলো কেএনএফের অত্যাচারের কথা বললেও নিরাপত্তাহীনতায় তাদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে না।
সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক : এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য রাজনৈতিক সমাধান লাগবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, কুকি-চিনের যে দাবিগুলো অবাস্তব, সেগুলো বাদ দিতে হবে। রাস্তাঘাট বানানো ও পর্যটনের বিরোধিতার বিষয়টি অযৌক্তিক। কারণ রাস্তাঘাট না হলে তারা স্কুলে যেতে পারবে না, অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে পারবে না। সরকার স্থানীয় জনগণের কল্যাণের জন্য স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে জুম মিটিং করে সমঝোতার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কেএনএফ তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করেনি। তাদের হাতে যে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র আছে তা আমাদের পাহাড়ি-বাঙালি বা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীÑ সবার জন্যই বড় হুমকি। তাই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সমঝোতার বিষয়ে সরকারি বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে।