মহাসমাবেশের পরদিন অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে আশানুরূপ আন্দোলন গড়তে না পারায় স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার তৃণমূলে যাচ্ছে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সুযোগ বুঝে রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের অহিংস আন্দোলন গড়ার পরিকল্পনা করছে দলটি। এতে গণঅভ্যুত্থানের মতো আন্দোলন গড়ে সরকার পতনের একদফা দাবি আদায় হবে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, তাদের লক্ষ্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন তারা চিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। চিল যেমন তার লক্ষ্য ঠিক করে আকাশে উড়তে থাকে এবং সুযোগ পেলেই ছোঁ মেরে তা শিকার ধরে, তেমনি বিএনপিও তার লক্ষ্য চূড়ান্ত করেছে। সেটি হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য সারাদেশে নিয়মতান্ত্রিক আরও নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নেবে দলটি। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে সরকার প্রমাণ করল তারা চাপে আছে। তিনি বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। কোনোরকম সহিংসতার পথে পা বাড়াবে না।
এদিকে, গত শুক্রবার ঢাকায় কয়েক লাখ লোকের অংশগ্রহণে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ হলেও পরের দিন রাজধানীর প্রবেশদ্বারের অবস্থান কর্মসূচিতে সেই রেশ দেখতে পাননি দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে দলের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করেন, আগের দিন মহাসমাবেশ থাকায় নেতাকর্মীরা ক্লান্ত ছিলেন বলে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, দলের বেশির ভাগ সিনিয়র নেতাসহ ঢাকার নেতাদের স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা না থাকা এবং সমন্বয়নহীনতার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেদিন স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি ও মহানগর নেতা এবং অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের কার কী ভূমিকা ছিল তা বিশ্লেষণ করছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
তবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, কোনো কর্মসূচি হলে আলোচনা-সমালোচনা হবেই। কিন্তু অবস্থান কর্মসূচি থেকে বিএনপির বড় অর্জন হচ্ছে দেশে-বিদেশে দলটির অসহিংস ভাবমূর্তি স্পষ্ট করতে পেরেছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায়কে যেভাবে রাস্তায় ফেলে পুলিশ পিটিয়েছে, তা সারাবিশ্ব দেখেছে।
এ প্রসঙ্গে গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপি যে সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না; জঙ্গিবাদকে সমর্থন দেয় না, তা বিশ্ববাসী বিশ্বাস করেছে। এক সময় বিদেশিরা প্রতিবেশী দেশের কারণে সরকারের অপরাধ চোখে দেখে নাই। এখন বিদেশিরা নিজের চোখে সরকারের অপরাধগুলো দেখছে, বুঝছে এবং গণতন্ত্রের কথা বলছে, মানবাধিকারের কথা বলছে- এটা আমাদের চলমান আন্দোলনে মনোবল আরও বৃদ্ধি করছে। কিন্তু বিদেশিরা আমাদের জনগণের সরকার এনে দেবে না, আমাদের ভোটের অধিকারও আদায় করে দেবে না, আমাদেরটা আমাদেরকেই আদায় করতে হবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর প্রবেশদ্বারের অবস্থান কর্মসূচি থেকে মাঠের দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে। আগের দিন বড় একটি মহাসমাবেশ সফল হলেও অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। সমন্বয়হীনতা ছিল স্পষ্ট। মহাসমাবেশ নেতাকর্মীসহ সাধারণ সমর্থকদের উজ্জীবিত করলেও পরদিন ঢাকা মহানগরীর প্রবেশদ্বারে দায়সারা অবস্থান কর্মসূচি আগের দিনের অর্জনকে অনেকটাই মøান করে দিয়েছে। এটাকে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমমনা দলগুলো সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের জন্য একটি ধাক্কা মনে করছে।
এই অবস্থায় ধাক্কা সামলে নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের কারও কারও মতামত, আপাতত কয়েকদিন সমাবেশ, বিক্ষোভ এবং কৃষক, শ্রমিক, মৎস্য ও তাঁতী দলের পূর্বঘোষিত পদযাত্রার মতো ‘নিরীহ’ কর্মসূচি চালাতে হবে। পাশাপাশি সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ১৫ আগস্টের পর আবার শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত বলে মত দেন তারা। দলের একাংশের নেতারা ধারাবাহিকভাবে বড় ধরনের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে চান। তারা মনে করেন, সরকার চাপে আছে। নরম কর্মসূচি দিলে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের গোছানোর সুযোগ পাবে।
বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি পালনের পর একদিন বিরতি দিয়ে জেলা ও মহানগর জনসভা দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচিতে বিরতিতে যাচ্ছে বিএনপি। কারণ, তিনদিন আগে ২৮ জুলাই মহাসমাবেশে জেলা নেতাকর্মীদের ঢাকায় অবস্থান করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
মহাসমাবেশ থেকে গত রবিবার কোনো প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ঘেরাও কর্মসুচি কিংবা অবস্থান কর্মসূচি আসবে এমন আলোচনা ছিল দলের ভেতরে। কিন্তু ঢাকার প্রবেশপথে যে অবস্থান কর্মসূচি আসবে- দায়িত্বশীল কোনো নেতার কাছে সেই ধারণা ছিল না। মহাসমাবেশ শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক পর কর্মসূচি জানানো হয় নীতিনির্ধারকদের। কর্মসূচি লিখে অন্য শরিকদের পাঠানোর জন্য দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য আগাম বক্তব্য দিয়ে চলে যান।
পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে আলোচনা ছাড়া কেন এমন কর্মসূচি নেওয়া হলো তা নিয়েও নীতিনির্ধারকদের অনেকে অসন্তুষ্ট হন। দলের একটি সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাইরে স্থায়ী কমিটির দুইজন নেতা এই কর্মসূচি সম্পর্কে জানতেন। এর মধ্যে একজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। এক নেতার প্রশ্ন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে এত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হবে কেন?
অবস্থান কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা
দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার মহাসমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার পর দলের সিনিয়র তিন নেতাসহ ও মহানগরের শীর্ষনেতারা ভার্চুয়ালি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন একজন নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান রাজধানীর প্রবেশদ্বারের অবস্থান কর্মসূচি কীভাবে সফল করা হবে? ওই নেতাকে তিনি বলেন, আপনি অতিথি হিসেবে অবস্থান কর্মসূচিতে যাবেন। দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। তখনও সিনিয়র নেতারা জানতেন না কার কী কাজ।
আলাপকালে বিএনপি নেতারা বলেন, কর্মসূচি থেকে কোন কোন স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন হবে তা বলা হয়নি। রাতে প্রথমে চারটি স্থানের কথা বলা হলেও পরে জানানো হয় পাঁচটি স্থানে হবে। নেতাদের কে কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়টি অনেকে জেনেছেন রাত ১২টার পর, কেউ জেনেছেন সকালে। ফলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার কোনো সুযোগ পাননি নেতাকর্মীরা। তা ছাড়া ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরা কোথায় দায়িত্ব পালন করবে, তাও পরিকল্পিত ছিল না।
দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, এ ধরনের অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে কয়েকদিনের প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়। তা ছিল না। এক নেতা বলেন, টানা কয়েকদিনের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তাদের প্রস্তুত হতে একদিন সময়ও দেওয়া হয়নি। ফলে মাঠের আন্দোলনের প্রভাব ছিল কম।
যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কারও কারও মত ছিল এখনই অবস্থান কর্মসূচি না দেওয়া। তাদের যুক্ত ছিল, মহাসমাবেশের কর্মসূচিতে সারাদেশ থেকে আসা নেতাকর্মীরা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। অনেকে তিনদিন ধরে ঢাকায় এখানে-ওখানে রাত কাটান। এই যুক্তিতে তারা এখন এমন কর্মসূচি না দেওয়ার মত দিয়েছিলেন। এর রেশ পড়ে সমন্বয়হীন কর্মসূচিতে। উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অনেকে কর্মসূচি নিয়ে কিছুটা উদাসীন ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কোন নেতা প্রবেশমুখের কোন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেবেন, সেটিও অনেক রাত পর্যন্ত ঠিক করা হয়নি। আবার স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, অনেকে যাননি। কেউ কেউ পরিস্থিতি দেখে গাড়ি থেকে নামেননি।
তবে বিএনপির নেতারা মনে করছেন, অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে সরকার হামলা-মামলা ও বাস পোড়ানোর মতো পুরনো কৌশলের পাশাপাশি এবার নতুন কৌশলও প্রয়োগ করেছে। কিন্তু কোনো কৌশল হালে পানি পায়নি।
দুই স্থানে ব্যর্থ সংগঠন
শীর্ষনেতাদের পর্যবেক্ষণ, রাজধানীর প্রতিটি প্রবেশদ্বারে অন্তত ২০-৩০ হাজার নেতাকর্মী থাকার মতো পরিকল্পনা ছিল। তবে কোথাও প্রত্যাশা অনুযায়ী সেভাবে জমায়েত হতে পারেনি নেতারা। যাত্রাবাড়ী-শনিরআখড়া ও ধোলাইখালে নেতাকর্মীরা দীর্ঘসময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ওই দুই স্থানের প্রভাব ছিল পুরো শহরে। কিন্তু গাবতলী ও উত্তরা- এ দুই স্থানে নেতাকর্মীরা সেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। উত্তরাতে কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটলেও তা প্রত্যাশিত ছিল না।
বিএনপির দুই নেতা বলেন, ধোলাইখালে সংঘর্ষের সময় গয়েশ্বরচন্দ্র রায় রাজপথে দুই হাত সম্প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। যেন পুলিশ বা নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে না জড়ায়। একপর্যায়ের পুলিশের ছোড়া ইট তার মাথায় লাগলে মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। এ অবস্থায় পুলিশ তাকে লাঠিপেটা করে। সড়কে পড়ে যাওয়ার পরও তাকে পেটাতে থাকে। গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, তার কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত বেধড়ক পিটিয়েছে।
অন্যদিকে, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের দায়িত্ব ছিল গাবতলী। সেখানে তার যাওয়ার আগে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু আমান বাসা থেকে রওনা দেওয়ার আগে ওই স্পটে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতার কর্মিবাহিনী নিয়ে থাকার কথা ছিল, তাদের ফোন দিতে দিতে গাবতলী স্পটে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কাউকে দেখতে পাননি। বিএনপির অভিযোগ, পুলিশের হামলায় আহত হলে আমানকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।