কমছে কৃষিজমি

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


গত এক যুগে সারাদেশে নিট আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৪ লাখ একর। প্রতিবছর ৭০ হাজার হেক্টর উর্বর কৃষি আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন দুই শতাংশ জমি লবণাক্ততায় অনাবাদি হয়ে পড়ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি জমিতে শিল্প এবং বসত বাড়ি নির্মাণের ব্যাপকতা বাড়ছে। ফলে ভূমির সুষ্ঠু ব্যবহার ও কৃষি জমি রক্ষায় এখনই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, ১৯৮২-৮৩ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত ফসলি জমি ছিল ৯ দশমিক ১৫ মিলিয়ন হেক্টর। ২০১৭-১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২ মিলিয়ন হেক্টরে। বলা হচ্ছে, অপরিকল্পিত আবাসন, শিল্পকারখানা, রাস্তা, উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে প্রতিদিন কমে যাচ্ছে প্রায় ২২০ হেক্টর কৃষি জমি। এই হিসাবে প্রতিবছর ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে, যা মোট কৃষি জমির প্রায় এক শতাংশ।

তবে প্রতিবছর এক শতাংশ কৃষি জমি কমে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে কৃষি জমি কমার পরিমাণ ছিল ০.৯৬ শতাংশ। এরপর ২০০৮-এ কমে দাঁড়াল ০.৭৪ শতাংশে। ২০১৮ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ০.২২ শতাংশ। মানুষের কৃষিবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে জমি কমে যাওয়ার হার কমে যাওয়া সম্ভব হয়েছে বলে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এটাও ঠিক যে, কৃষি জমি কমার এই হার কখনোই শূন্যের কোঠায় নামবে না।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশের আবাদযোগ্য জমি ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর এবং আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৫১ একর বা ৯১ হাজার ২৭৭ হেক্টর। ভূমি সংস্কারে নিয়োজিত অলাভজনক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা বলেছে, বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ বনভূমি, ২০ দশমিক ১ শতাংশ স্থায়ী জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট রয়েছে। বাকি ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে বছরে এক হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। নির্মাণকাজে বছরে বিলীন হচ্ছে তিন হাজার হেক্টর জমি। গত ৩৭ বছরে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে। এ ছাড়াও ৮০ শতাংশ খাসজমিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন-২০১০ অনুযায়ী কৃষি জমিতে অন্য কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও তা কার্যত বাস্তবায়িত হয়নি।

কৃষি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি জমি কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। প্রতিবছর দেশে ২২ থেকে ২৫ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। সেই বাড়তি মানুষের খাদ্যের জোগান এই কৃষি জমির উৎপাদন থেকে দিতে

হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা বাড়তে থাকা এই দেশে কৃষি জমি রক্ষা করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কৃষি জমির পরিমাণ যে হারে কমছে, তাতে অচিরেই কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বিভাগওয়ারি অকৃষি খাতে জমি চলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। প্রতিবছর চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর, রাজশাহী বিভাগে ১৫ হাজার ৯৪৫ হেক্টর, ঢাকায় ১৫ হাজার ১৩১ হেক্টর, খুলনায় ১১ হাজার ৯৬ হেক্টর, রংপুরে ৮ হাজার ৭৮১ হেক্টর, বরিশালে ৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমি অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানের মাথাপিছু চাষযোগ্য জমি ১৪ শতক থেকে কমে ৬.২০ শতকে নেমে আসতে পারে। এতে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের এক গবেষণা বলছে, ১৯৭২-২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৬ একর জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। এর মধ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৮৯ একর জমিতে, দোকান নির্মাণ হয়েছে ৬ হাজার ২৬২ একর, বিদ্যালয় দুই হাজার ৮২৭ একর, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ৪৯৯ একর ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে এক হাজার ৯৯৯ একর জমিতে।

নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন বর্তমানে সময়ে কৃষিজমি রক্ষা করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সবার আগে জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০-এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।

?কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ক্রমর্বধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জমি হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানামুখী চ্যালঞ্জে মোকাবিলা করে খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করতে হলে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তর করে যুগোপযোগী করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগামীদিনে কৃষি উৎপাদনে জলবায়ু সহনশীল ও উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন জাত ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *