রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশে কয়েক দিন নমনীয় থাকার পর আবার কঠোর হতে যাচ্ছে পুলিশ। অবস্থা বুঝে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘হার্ড লাইনে’ যাওয়ার কথাও বলছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এদিকে গতকাল বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
বিএনপির মহাসমাবেশ সামনে রেখে গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত দলটির দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজধানী থেকে। এ ছাড়া জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাজধানীর যে কোনো সড়কে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয় ভাবছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিলে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের মতো বিএনপি নেতাকর্মীরা সেখানে অবস্থান নিয়ে নিতে পারেন। তাই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে ও জনদুর্ভোগ কমাতে বিএনপিকে ঢাকার কেন্দ্রের বাইরে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, বৃহস্পতিবার কর্মদিবসের কারণেই নয়াপল্টন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিতে চান না তারা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ব্যাপারে হাইকোর্টের একটা অবজারভেশন আছে। জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা বিএনপিকে গোলাপবাগে সমাবেশ করার পরামর্শ দিয়েছি। মানুষকে কষ্ট না দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশ করা উচিত। ভবিষ্যতে হয়তো এমন সময় আসবে, যখন জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে গেলে এসব কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা লাগতে পারে।
বিএনপি গত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠে একটি সমাবেশ করে। ওই সমাবেশ তারা করতে চেয়েছিল ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে। তবে পুলিশ সেখানে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলা হয়। কিন্তু বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। এবার বিএনপির পক্ষ থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা নয়াপল্টনে সমাবেশের আগ্রহের কথা জানানো হয়। পুলিশ তাদের গোলাপবাগ মাঠে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তবে গতকাল রাত ৯টায় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা বৃহস্পতিবার নয়, আগামীকাল শুক্রবার নয়াপল্টনেই মহাসমাবেশ করতে চাই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন গতকাল রাতে আমাদের সময়কে বলেন, এখনো বিএনপি কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে বৃহস্পতিবার সমাবেশের ব্যাপারে অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিছু দিন ধরেই এ রকম একই দিনে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলছে, ফলে কর্মসূচির দিন যানজটের ভোগান্তির পাশাপাশি সহিংসতার আশঙ্কাও জনমনে থাকছে। তাই সব কিছু বিবেচনা করে সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শুক্রবার ও শনিবার সমাবেশের অনুমতি চাইলে পুলিশের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর মিরপুর এলাকার চারটি থানা থেকে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ডেমরা থানা বিএনপির ১২ নেতাকর্মীকে।
পুলিশ বলছে, পরস্পরবিরোধী দলগুলোর সমাবেশ কেন্দ্র করে সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে। তাই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপনের পাশাপাশি রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে মেটাল ডিটেক্টরসহ অতিরিক্ত পোস্ট বসাবে। বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারে গোয়েন্দাদের নেতৃত্বে অভিযান চালানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির সমাবেশের ফুটেজ ধারণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হবে এবং সমাবেশস্থলের চারপাশে নজরদারি বাড়ানোর জন্য ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খ তল্লাশি নিশ্চিত করতে চেকপোস্টগুলোতে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করা হবে। নিরাপত্তা জোরদারে পুলিশ সাদা পোশাকেও মাঠে থাকবে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ যাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিএনপির সমাবেশস্থলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঢাকায় কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ কেন্দ্র করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা নিয়মিত প্যাট্রলিং করব, চেকপোস্ট স্থাপন করে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবে র্যাব। মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে, যাতে কেউ অবৈধ অস্ত্র নিয়ে বা নাশকতা সৃষ্টির মতো কোনো ধরনের সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। চেকপোস্ট স্থাপন করে প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।
খন্দকার মঈন আরও বলেন, আমরা সাইবার প্যাট্রলিং করব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি যেন কেউ না করতে পারে, সেদিকে আমাদের নজরদারি থাকবে।
গতকাল বিকাল ৪টার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দুই পাশের সড়কে দুটি জলকামান ও একটি ‘রায়ট কার’ অবস্থান নেয়। কার্যালয়ের তিন পাশে দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল।
গতকাল সন্ধ্যায় দেখা যায়, বিএনপির কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশে পল্টন জামে মসজিদের সামনে পুলিশ সদস্যদের একটি দল অবস্থান করছে। সেখানে একটি জলকামান রয়েছে। কার্যালয়ের উত্তর পাশে পুলিশের আরেকটি দল রয়েছে। সেখানে একটি জলকামান ও একটি রায়ট কার রয়েছে। কার্যালয়ের উল্টো দিকে রাস্তায় পুলিশ সদস্যদের আরেকটি দল অবস্থান করছে। দুপুর থেকে বিপুলসংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিলেও পুলিশ অবস্থানের পর কমতে থাকে। দলের কার্যালয়ের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সমাবেশের আগে সাংঘর্ষিক কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে তারা মুখোমুখি হতে চান না। তাই কর্মীদের সরে যেতে বলা হয়।