জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি ও দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব হয়ে উঠছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। একই দিন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও কর্মসূচি ডেকেছে। পরস্পরবিরোধী হিসেবে বিবেচিত দেশের বড় এই দুটি দল রাজধানীতে একই দিন কর্মসূচি ডাকায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। শুধু তাই নয়, এ উত্তাপ উদ্বেগ ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজনীতির বাইরের মানুষজনের মনেও। বিশেষ করে, দুই দলের এ কর্মসূচি দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছে পরিবহন খাতেও।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতার জের পরিবহন খাতে যে বিনাশী-দশা সৃষ্টি করেছিল, সে তিক্ত অভিজ্ঞতার জেরে এক ধরনের ভীতি সঞ্চারিত হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মনে। সঙ্গত কারণেই আগামীকালের কর্মসূচি নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন তারা। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।
দেশে যে কোনো রাজনৈতিক সহিংসতায় সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী পরিবহন খাত। অথচ এই খাতের সঙ্গে দেশের পুরো অর্থনীতি সরাসরি সম্পৃক্ত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দেশের সর্বত্র অসংখ্য বাস, মিনিবাস, লেগুনা, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ সবরকম যানবাহনে চলে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ। সেটা এতোই বিনাশী হয়ে ওঠে যে, ধ্বংসাত্মক এ কর্মকা-ের জেরে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। ব্যাংক ঋণে, মানুষজনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে কেনা যানবাহনের টাকা সুদসহ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই বাধ্য হন পরিবহন ব্যবসা গুটিয়ে নিতে। তৎকালের ধ্বংসাত্মক কা-ের কোপানলে পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি এবং বাংলাদেশ রেলওয়েও। উপড়ে ফেলা হয় রেললাইনের ফিশপ্লেট। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বাসে, ট্রেনের ইঞ্জিনে-বগিতে।
উপরন্তু, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং তৎপরবর্তী সময়কালে রাজনীতির মাঠ চরম উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় রাজপথে সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো কা-ও ঘটতে পারে। আসছে দিনগুলোয় পরিবহনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, ভীত ব্যবসায়ীরা। শঙ্কিত সাধারণ যাত্রীরাও। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ চান সর্বসাধারণ।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ আমাদের সময়কে বলেন, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে যানচলাচল নির্বিঘœ হয়। তিনি বলেন, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ আর দেখতে চাই না। কেবল পরিবহনের মালিক-শ্রমিকই নন, সাধারণ মানুষও এর ক্ষতির শিকার। এ ধরনের হীন কা- কারোই প্রত্যাশিত নয়। গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখলে পরিবহন খাতের আর্থিক ক্ষতি হয়। আবার জ্বালাও-পোড়াওকালে চলাচল করলেও আমরা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হই। জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব কা-ের পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না কেউই।
একই ইস্যুতে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী আমাদের সময়কে বলেন, দেশের অস্থির পরিস্থিতিতে কেবল পরিবহনকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা-ই নয়। যাত্রী হিসেবে সাধারণ মানুষও এর শিকার। গাড়ি ভাঙচুরে, অগ্নিকা-ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি যাত্রীরাও আক্রান্ত হন। তিনি বলেন, আমরা এমন অবস্থা আর চাই না। জীবিকার তাগিদে গাড়ি রাস্তায় নামানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হলে রাস্তায় গাড়ি বের করা যায় না।
জানা গেছে, সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলে একদিনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চলা সহিংসতায় শুধু যানবাহনের ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৫৩ লাখ ২২ হাজার ২৬০ টাকার। গাড়ি পুড়িয়ে ফেলায় ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮৬০ টাকা। আর ভাঙচুরে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৫৯ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ টাকা। এ হিসাব সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির। হরতাল-অবরোধে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ১১০২টি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে গাড়ি পুড়েছে ৪৭৬টি এবং ভাঙচুর হয়েছে ৬২৬টি। যদিও হরতাল-অবরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির ক্ষতিপূরণ মিলেছে। ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬টি পোড়া গাড়ির জন্য ৪ কোটি ২০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। একই বছরের ১২ মার্চ ২৬৫টি দগ্ধ-ভাঙচুরকৃত গাড়ির জন্য অনুদান মিলেছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে পোড়া গাড়ি ৬৯টি এবং ভাঙচুর হওয়া ১৫৬টি। ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল ৬৫টি পোড়া গাড়ির জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৪র্থ পর্বে একই বছরের ৩০ জুলাই ১৮৬টি পোড়া গাড়ির জন্য ৬ কোটি ৬৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা অনুদান মিলেছে। চার পর্বে মোট ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এদিকে ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়া এবং রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনায় রেলের ক্ষতি হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। বিআরটিসির বাসের ক্ষতি হয়েছে ১৮ কোটি টাকা।
পরিবহনকর্মীরা জানান, মালিকরা ব্যবসার জন্য পরিবহন সেক্টরে বিনিয়োগ করেছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে পুঁজি হারানোর অবস্থা তৈরি হয়। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারার মতো অবস্থা ছিল গেল সহিংসতায়।
প্রয়োজনের তাগিদেই বাস চালানোর পক্ষে বাস মালিকরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় পরিবহন সেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। ১০ হাজারের বেশি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার বাস। ভাঙচুর করা হয়েছে পাঁচ হাজারের মতো যাত্রীবাহী গাড়ি। পেট্রোলবোমা মেরে, আগুন দিয়ে এমনকি নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৫৬ চালককে। নিহত ৪২ চালকের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অনুদান পেয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিকদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অনুদান দেয়া হয়েছে। ওই সময়ে দুই দফায় ৫০ দিনের বেশি সময় পরিবহন সেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ছাড়িয়ে গেছে।
যাত্রী-পণ্য পরিবহনে সম্পৃক্ত শ্রমিকরা বলছেন, দেশের পরিবহন খাত জনগণের জন্য, কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য নয়। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস আন্দোলনের কারণে পরিবহন খাত হুমকির মুখে পড়ে।
পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা জানান, যাত্রীবাহী বাস, বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়ি, পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান- কোনো ধরনের মোটরগাড়িই নাশকতার হাত থেকে রেহাই পায় না। কোনো আন্দোলন এলে প্রথমেই আঘাত আসে পরিবহনের ওপর। গণপরিবহন বা ব্যক্তিগত পরিবহন কোনোটাই ছাড় পায় না। পরিবহনকর্মীরা খেটে খাওয়া মানুষ। সরকার বা বিরোধী দলের রাজনীতির লোক নন। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে। পরিবহন খাতেও নানা দল-মতের লোক রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবাই, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো দেশের অর্থনীতি।
সহিংসতা পরিহারের আহ্বান মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার তিনি আমাদের সময়কে আরও বলেন, অতীতে নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের আগে-পরে দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক সহিংসতা হয়েছে। এতে অনেক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। এটি কখনোই কাম্য নয়। এতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেকে পথে বসে যায়।
মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে; ভোট চাওয়ার অধিকারও আছে। প্রত্যেক নাগরিকের এই অধিকার আছে। এখন যারা রাজনীতি করেন তাদের এ বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করা উচিত। মানুষ যেন কোনোভাবেই বিপদগ্রস্ত না হয়, সেটি স্মরণে রেখে রাজনীতি করা উচিত।
মানবাধিকার কমিশন আগামী নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলবে। ওখানে তাদের আমরা গাইডলাইন দেব যেন সহিংসতামুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষ যেন ভিকটিম না হয়।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় কাজ করবে। এক্ষেত্রে সবার উচিত কমিশনকে সহযোগিতা করা। মানুষের ভোটের অধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে যেন কোনো বাধাবিপত্তি না থাকে; অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেন হয়, এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন কাজ করবে।