সরকার পতনের একদফা নিয়ে ঢাকামুখী চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। মূলত এ লক্ষ্যে আগামী বৃহস্পতিবার ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে দলটি। ‘চলো চলো, ঢাকা চলো’ সেøাগান তুলে বিএনপির ৮২ সাংগঠনিক জেলার নেতাকর্মীরা এ মহাসমাবেশে যোগ দেবেন। কয়েক লাখ লোকের জমায়েত ঘটিয়ে এ মহাসমাবেশ থেকেই একদফার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে দলটি।
পরের কর্মসূচির ধরন কী হবে- এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে বাধা এলে আন্দোলনের ধরন পাল্টে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহাসমাবেশের পর দলটি সরকার পতনের দাবিতে রাজধানীতে টানা কর্মসূচিতেও যেতে পারে। এমন ভাবনা নিয়ে বিএনপি তাদের মহাসমাবেশকেন্দ্রিক পরিকল্পনা সাজাচ্ছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, আগামী দিনে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আরও ত্বরান্বিত ও তীক্ষè হবে। জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেই এই সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হবে।
আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, সরকার পতন ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একদফা দাবি জাতির সামনে পেশ করেছি। এর পক্ষে সর্বোচ্চ সমর্থনও পাচ্ছি।
রাজপথে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ। এখন দেশবাসীকে চূড়ান্ত ফলের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা, রাজধানীর মহাসমাবেশে আসার পথে পুলিশ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা বাধা দিতে পারে। এ জন্য কর্মসূচির দু-একদিন আগেই দূর-দূরান্তের জেলার নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, হঠাৎ ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকার পেছনে একটির উদ্দেশ্য হচ্ছে- আন্দোলনের গতি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এ জন্য পদযাত্রা কর্মসূচির পরেই মহাসমাবেশ ঘোষণা করা হয়েছে। অতীতে ঢাকায় যত মহাসমাবেশে হয়েছে, তার আগে ক্ষমতাসীনদের বাধার কারণে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, সরকারের টানা ১৪ বছরের শাসনামলে রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল না হওয়ার এটি একটা বড় কারণ। তাই এবার ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি সাজানো হচ্ছে। মহাসমাবেশের পরও ঢাকার বাইর থেকে আসা নেতাকর্মীদের নিয়ে টানা কর্মসূচি পালনের চিন্তা আছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, দলের নেতাকর্মীরা ঢাকায় অবস্থান নিয়ে কয়েকদিন বড় কর্মসূচি করতে পারলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও প্রশাসনে আন্দোলন নিয়ে ভীতি তৈরি হতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আস্থা বাড়বে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তা সরকারের সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
অবশ্য কোনো কোনো নেতা মনে করেন, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বিদেশি প্রভাবশালী কিছু দেশের আগ্রহ আছে। ঢাকার মহাসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের শক্তি দেখাতে চাইছে। রাজধানীতে আন্দোলনের শক্তি দেখাতে পারলে বিএনপি বিদেশিদের সমর্থন পাবে। দলের অনেক নেতা মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা প্রেক্ষাপটের কারণে বিদেশিদের সমর্থন ছাড়া সরকার পতন সম্ভব নয়।
বিএনপি নেতাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে কর্মসূচি দেওয়াকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু কয়েক মাসে বিএনপির আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সেই কৌশল তেমন সফল হয়নি। কারণ বিএনপির সব কর্মসূচি সফল হয়েছে; সেভাবে বাধা আসেনি। বাধা এলে প্রতিরোধও হয়েছে। ভিসানীতি চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবারের আন্দোলনে সরকার বাধা দিতে এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর বাধা না দিলে বিএনপির আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করবে।
দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বিএনপি আন্দোলনের সফলতা দেখতে চায়। এক্ষেত্রে দলের নেতাদের যুক্তি হলো, তফসিল ঘোষণার পর ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। তখন অনেক দল সরকারের নানা প্রলোভনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়।
সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। বিএনপির সন্দেহ- জানুয়ারির কথা বললেও ক্ষমতাসীনরা তার আগেই সংসদ নির্বাচন করবে। স্কুল-কলেজের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের সঙ্গে বিষয়টির যোগসাজশও খুঁজে পাচ্ছেন দলের শীর্ষপর্যায়ের অনেক নেতা।
রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, সরকার পতনের একদফা ঘোষণার দুই সপ্তাহের মাথায় ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকার মধ্য দিয়ে বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাতে চাইছে। যদিও তারণ্যের সমাবেশ থেকে বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা নিয়ে দলের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা দেখিয়ে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে চায়। বিএনপির ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের পদযাত্রা কর্মসূচিতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। পদযাত্রা কর্মসূচিতে লক্ষ্মীপুরে কৃষক দলের এক কর্মী নিহত হন। এ ছাড়া আরও তিন হাজার নেতাকর্মীকে আহত করা হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের মতে, বিএনপি শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে চাইলেও সরকারই সংঘর্ষ উসকে দিচ্ছে। এ অবস্থায় চার দিন পর ঢাকায় যে মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছে, সে সমাবেশে বাধা দেওয়া হলে বিএনপির কর্মসূচি যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে।
বিএনপির নেতৃত্ব এবার ঢাকায় বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে বেশ কয়েক মাস ধরেই দলকে নানাভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক মাস ধরে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। এসব বৈঠকে প্রতিটি জেলা থেকে ঢাকার কর্মসূচিতে লোকসমাগম ঘটানোর কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের চিন্তা অনুযায়ী, ঢাকায় লাগাতার বৃহৎ কর্মসূচির মধ্য দিয়েই আন্দোলনকে তারা চূড়ান্ত সফলতার দিকে নিয়ে যেতে চান।
‘বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে জাতীয় নির্বাচন’ এগিয়ে আনার গুঞ্জনও আমলে নিচ্ছে বিএনপি। ১৪ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনমুখী প্রস্তুতির বিষয়টি বিএনপি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেশি-বিদেশি চাপ সত্ত্বেও সরকারের সাম্প্রতিক ‘মতিগতি’ বিএনপি বেশ সন্দেহের চোখে দেখছে এবং সে অনুযায়ী তারা আন্দোলনের পরিকল্পনাও পুনরায় সাজিয়ে নিচ্ছে। বিএনপি মনে করছে, বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনের মতো আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ক্ষমতার ধারা টিকিয়ে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে সেটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে তা আরও স্পষ্ট হবে।
আজ বিএনপির যৌথ সভা
বৃহস্পতিবারের মহাসমাবেশ সফল করতে আজ সোমবার যৌথ সভা ডেকেছে বিএনপি। দুপুর ১২টায় নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা হবে। সভাপতিত্ব করবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ যুগ্ম মহাসচিব, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।