দুপক্ষকেই আলোচনার কৌশল ও পথ খুঁজে নিতে হবে

Slider বাধ ভাঙ্গা মত

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান দুটি দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে। সংবিধান আছে, তবে তাতে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল। তারা চায় উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মতো ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনের সময় রুটিন দায়িত্ব পালন করবে আর নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। কিন্তু তাদের আমলে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল হলেও এবং যথেষ্ট ভোটারের সমর্থন পেলেও কেবল ক্ষমতা নয় মূল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেই ছিল এতদিন। তবে গত কয়েক মাস ধরে সঠিক কৌশলে আন্দোলন পরিচালনা করে তারা রাজপথে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছে। তাদের গণঃসংযোগের এই সাফল্য এবং নিরপেক্ষ অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্যে পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের তৎপরতা তাদের পক্ষে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং মাঠ না থাকার অভিযোগে কিছু সত্যতা থাকলেও বিদেশি দূত ও সরকারের তৎপরতা মাঠকে বিপুলভাবে তাদের অনুকূল করে তুলছে। এটা থামাতে ক্ষমতাসীন দল ও জোট তাদের অবস্থানে অনড় থাকার কৌশল প্রয়োগ করছে। সকলেই বোঝেন রাজনৈতিক এবং সরকারের কাজ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে তার সমাধান মাঠে সম্ভব নয়। বরং দীর্ঘদিন মাঠে প্রতিপক্ষতার চর্চা চলতে থাকলে এক পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অশান্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। অতএব আলোচনার কথা উঠবেই।

রাজনীতি যতটা বক্তৃতা-বিবৃতি ও বিতর্ক-কৌশলের বিষয় ততটাই, বা তারও চেয়ে বেশি, আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়। দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা ও সংলাপের দূতিয়ালি যে অতীতে হয়নি তা নয়, হয়েছে। তবে বিদেশিদের উদ্যোগ তা জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথের মতো সংস্থার হলেও সাধারণত সফল হয়নি। সফল হয়েছে দেশীয় মধ্যস্থতা ও দূতিয়ালি। এরশাদের পতন ও পরবর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে আন্দোলনরত তিন জোটের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও তা কার্যকর করার কাজে সুশীল সমাজের তৎপরতা সফল হয়েছিল। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের এতটা জড়িয়ে পড়া ও মতামত-মন্তব্য প্রদান কাম্য নয়, গ্রহণযোগ্য নয়। তা দেশ ও জনগণের জন্যে সম্মানজনকও নয়। তাতে রাজনীতিকদের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হয়।

বাস্তবতা হলো, সরাসরি সংলাপ এখনই সফল হবে না। কিন্তু নাগরিক সমাজের পেশাজীবীদের মধ্যে যাঁরা দুই পক্ষের কোনো না কোনো এক পক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠ তাঁদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা দিয়ে সংলাপ শুরু হতে পারে। বরফ গলতে শুরু করলে মাঠপর্যায়ের উত্তাপ কমতে শুরু করবে। তখন সংঘাত ও অনভিপ্রেত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এড়ানোর পথ বের করাও সহজ হবে।

বলা দরকার, শেখ হাসিনা গত পনের বছরে দলে ও দেশে একক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হয়ে উঠলেও এবং বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণের অংশটুকু বাদ দিলে, উন্নয়ন, জনকল্যাণ এবং প্রশাসনিক, সামাজিক দায় পালনে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ভূমিকায় তিনি বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর আমলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতা অনেক কমে গেলেও, এমনকি সামাজিক পরিসরে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামি দলের সাথে দলটির নৈকট্য বাড়লেও, তারা প্রধান বিরোধী দলের সাথে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকেই মূল উপজীব্য করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ফসল যে বাংলাদেশ তার ইতিহাসে কোনো নেতা-নেত্রীর এমন ভাবনাকে ভুল বলা যাবে না। কিন্তু তাঁরাই আবার ক্ষমতায় বসে রাজনীতিকে এমন জায়গায় এনেছেন যে, জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও এর প্রকৃত চর্চা সম্পর্কে যথেষ্ট ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বর্তমান সময়ের মতো পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ডাক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি নিয়ে মাঠে নেমে এর বিরুদ্ধ শক্তিকে মোকাবিলা করার মতো অবস্থা কি তাঁদের আছে? নিজেদের ওপর সেরকম আস্থা কি তাঁরা পান? রাজনীতিতে অসঙ্গতি জমতে থাকলে জনগণ বিভ্রান্ত হবেন- তা বুঝতে হবে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে চর্চা হবে তার আদর্শ ও চেতনার রসদ তো আসবে স্বাধীনতার রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে। কিন্তু সে চর্চা ব্যাহত করে বা স্থগিত রেখে একে কেবল বক্তৃতা ও উদযাপনের বুলি-আড়ম্বরে পর্যবসিত করে আওয়ামী লীগ নিজের রাজনীতির ভিত দুর্বল করেছে। তদুপরি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ দলকে তোয়াজ করলেও জোটসঙ্গী দলগুলোরও মূল্যায়ন করেনি। বামপ্রগতিশীল শক্তি যত ক্ষুদ্রই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির জন্যে তাদের এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকা যে গুরুত্ববহ তা ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনায় থাকেনি। মনে রাখা দরকার, ক্ষমতার প্রতাপ, পেশিশক্তি কিংবা সংঘাত দিয়ে রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হওয়া যায় না। এমনকি যুদ্ধেও শেষ পর্যন্ত অস্ত্র সংবরণ করে মধ্যস্থতার মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে সমাধান খুঁজতে হয়।

সময় কম, মনে হয় সব পক্ষকেই আলোচনার কৌশল ও পথ খুঁজে নিতে হবে, নয়তো মাঠ উত্তপ্ত হতে থাকলে রাজপথে ও আন্দোলনে কথা বলার লোক ও পক্ষ বাড়বে। এটা হবে আগুনে ঘৃতাহুতির মতো। এমন ঘটলে বিভিন্ন পক্ষ মাঠে নেমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে, তাতে অনভিপ্রেত ঘটনাও বাড়তে থাকবে। এটা কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ-চিত্র হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে এবং তারা তার যোগ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *