.একুশ বছর পর ভারত থেকে পরিবারের কাছে ফিরে এলেন বাংলাদেশের নাগরিক মতিউর রহমান (৩৬)। আজ শুক্রবার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি। তাকে ফিরে পেয়ে বাধভাঙার আনন্দে কাঁদতে থাকেন স্বজনরা।
আজ সকাল ৯টা থেকেই স্বজনরা বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্টে মতিউরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। দুপুর আড়াইটার দিকে ভারতের ফুলবাড়ী ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্টে মতিউর রহমানকে নিয়ে আসেন বিএসএফ ও ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নিতিশ শর্মা ও সহযোগী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. স্বরালি কে কোন্ডউইলিকার। তারা তাকে বিজিবি সদস্য ও ইমিগ্রেশনের এএসআই খায়রুল ইসলামের মাধ্যমে পরিবারের কাছে তুলে দেন।
ছেলেকে কাছে পেয়ে মতিউরের মা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে একুশ বছর পেয়েছি। বুকের ধন ফিরে এসেছে। খোদার কাছে সন্তানের জন্যে কেঁদেছিলাম, খোদা আমার কথা শুনেছেন।’
মতিউরের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সন্তান হারানোর কষ্ট যে কত কঠিন তা সবাই বুঝতে পারবে না, আমার পরিবার সেই কষ্ট বুঝেছে। দীর্ঘ একুশ বছর ধরে ছেলের অপেক্ষা করতে করতে বুকের মধ্যে কষ্টের পাথর বেধে রেখেছিলাম। আজ ছেলেকে যারা ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতিশ শর্মা বলেন, ‘আমরা ২০১৯ সালে জুনে ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার এক রাস্তা থেকে মতিউরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় উদ্ধার করি। আমরা মানসিকভাবে যারা বিপর্যস্ত, যারা রাস্তায় থাকেন, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করে থাকি। মতিউর রহমানকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমরা খুশি।’
পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের সহযোগী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. স্বরালি কে কোন্ডউইলিকার বলেন, ‘আমরা মতিউরকে অসুস্থ্য অবস্থায় পেয়েছিলাম। তার রোগটি খুবই জটিল। এ রোগটি সম্পর্কে অনেকে জানে না। অনেক জায়গা ও গ্রামে এ রোগের চিকিৎসা সুবিধা নেই। এ কারণে এ রোগের আক্রান্তকারীরা বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়। যেকোন জায়গায় চলে যায়। এ রোগের অবশ্যই চিকিৎসা আছে ও ঔষুধও আছে। তাই আমরা যতোটা পারি উদ্বুদ্ধ করি। মতিউরকে সুস্থ করে তার পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরে স্বার্থক মনে করছি।’
তেতুঁলিয়া থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) খায়রুল ইসলাম জানান, ‘মতিউর রহমান দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছিলেন। তিনি আজ ভারত-বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও এনজিওর মাধ্যমে দেশে ফিরেছেন। আমরা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।’
দেশে ফিরে মতিউর রহমান অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ভারতে ছিলাম। ভাবতে পারিনি দেশে ফিরে মা-বাবার কাছে আসতে পারব। আমি অসুস্থ ছিলাম, যারা আমাকে দেশে ফিরিয়ে দিল আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। দেশে ফিরে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’
মতিউরের ছোট বোন সাইফুন্নাহার বলেন, ‘ভাইকে ক্লাশ ফোরে পড়ার সময় হারিয়ে ফেলেছিলাম। একুশ বছর ভাইকে ফিরে পাব এ আনন্দ প্রকাশ করার মতো নয়। ভাইকে ফিরে পেতে ঠাকুরগাও থেকে বাংলাবান্ধায় ছুটে এসেছি।’
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর থানার আখানগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রোমান বাদশা বলেন, ‘২১ বছর আগে আমার ইউনিয়নের শহিদুল ইসলামের বড় ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর পর সে ভারত থেকে বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। খবর পেয়ে তার পরিবারকে নিয়ে মতিউরকে নিতে ছুটে এসেছি। সত্যিই আনন্দ লাগছে।’
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে হারিয়ে যান মতিউর। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার সদর থানার আখানগর ইউনিয়ন পরিষদের ঝারগাঁও গ্রামে। তিনি হারিয়ে যাওয়ার পর ঠাকুরগাঁও সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তার পরিবার।
২০১৯ সালের জুনে ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার এক রাস্তা থেকে মতিউরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। মতিউরকে উদ্ধার করার পর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হিসেবে শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। সেখানে চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, তিনি বাংলাদেশি। মহামারি করোনা শুরু হলে মতিউরের পরিবার সন্ধানের বিষয়টি স্থবির হয়ে পড়ে।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আহমেদাবাদের বেসরকারি সংস্থা ‘স্নেহালয়’ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়। মতিউরকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের রাহা নবকুমার ও তার স্ত্রী তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতিশ শর্মা। রাহা নবকুমার ও তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে একসময় ঠাকুরগাঁওয়ে মতিউরের স্বজনদের খুঁজে বের করে গত ২৭ জুন মতিউরকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাগজপত্র জটিলতার কারণে তাকে সেদিন দেশে পাঠানো হয়নি।