ডেঙ্গুর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচয় পুরনো হলেও এবারের চিত্র সবকিছু পাল্টে দিচ্ছে। এমনকি বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে এক হাজার ৭৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে এ বছর ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৯২ জনে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে গত একদিনে মারা গেছেন আরও ১৯ জন, যা দেশের ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এতে করে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৬ জনে ঠেকেছে। এর মধ্যে চলতি মাসেই মারা গেছেন ৯৯ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে প্রতি হাজারে মৃত্যুর হার ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর অর্থ প্রতি ১৭৭ জনে মারা গেছেন একজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারে মশার আচরণ যেমন বদলে গেছে, তেমনি একাধিকবার আক্রান্তের ঘটনাও বেড়েছে। এতেই মৃত্যুহার বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘বর্তমানে আক্রান্তদের অধিকাংশই আগে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন। এতে করে যে অ্যান্টিবডি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) তৈরি হয়েছে তার সঙ্গে নতুন অ্যান্টিজেনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, যা মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে। রক্তনালির ছিদ্রগুলো বড় করে দেয়, ফলে রক্তের জলীয় অংশ বের হয়ে যায়। এ ছাড়া এডিস মশা প্লাটিলেটকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, ফলে কিডনি, লিভার ও হার্ট আক্রান্ত করছে। এতে করে মাল্টি অর্গান ফেইলর হওয়ায় মৃত্যু বেশি হচ্ছে।’
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের (ইসিডিসি) তথ্যমতে, গত ৮ জুন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ২২ লাখ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯৭৪ জন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫ লাখের মতো আক্রান্ত ব্রাজিলে। এ ছাড়া বলিভিয়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার, পেরুতে ১ লাখ ১৬ হাজার এবং আর্জেন্টিনায় লাখের মতো ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
তবে এসব দেশে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। সর্বোচ্চ রোগীর দেশে ব্রাজিলের প্রতি হাজারে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ, বলিভিয়ায় শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, পেরুতে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনায় শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, লাউস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের ডেঙ্গুর বিস্তার রয়েছে। এসব দেশেও মৃত্যুহার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার ঘনত্ব বাড়ায় আক্রান্ত রোগী বেড়েছে আগের তুলনায় বেশি। এক ব্যক্তি কয়েকবার আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু জ¦র একেবারে তীব্র না হয়ে থেমে থেমে হচ্ছে। এতে করে হাসপাতালে সঠিক সময়ে যেতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না রোগীরা। ফলে মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘জ¦র চলতে থাকলে ক্রিটিক্যাল অবস্থা শুরু হয়। একটু সুস্থ হলেও শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও শরীর খুব খারাপ লাগে। দুদিন পর আবারও জ্বর শুরু হলে তীব্র না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না অনেকে। এতে করেই মৃত্যু বেশি হচ্ছে। অনেকের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় চিকিৎসকের শরণাপন্নই হচ্ছেন না। ফলে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মৃত্যুর হার বেশি। শুধু তাই নয়, পুরুষরা হাসপাতালে কম হলেও নারীরা আরও কম যাচ্ছে। ফলে নারীদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ছয় হাজার রোগী সারাদেশে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে বহু রোগী আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয় কিছুটা সীমিত হলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। উচ্চমূল্যের আইসিইউ থেকে শুরু করে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় অনেক বেশি।
এমতাবস্থায় রোগী কমানো ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যে পদ্ধতিতে মশক নিধন কার্যক্রম চলছে সেটি কার্যকরি কোনো ব্যবস্থা না। দুঃখের বিষয়, গত তেইশ বছরে ভাইরাসটির সঙ্গে লড়ে এলেও এখনো গতানুগতিক কাজের বাইরে সিস্টেম উন্নত করতে পারিনি আমরা। ফলে নির্মূল করা যাচ্ছে না।’
বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘মশা নিধনে বৈজ্ঞানিক মত দিতে পারেন কীটতত্ত্ববিদরা। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনে সেই ধরনের পদ নেই। অথচ তাদের তত্ত্বাবধানে এলাকাভিত্তিক নির্মূলে কাজ করার দরকার ছিল। ঢাকায় যেহেতু সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু, তারা বলতে পারতেন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে মৃত্যু বাড়লেও চেয়ে দেখা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই।’
ভোলা (উত্তর) প্রতিনিধি জানান, ভোলায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়া সংক্রমণ। প্রতিদিনিই এ দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন গড়ে ২০ থেকে ৩০ জন রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২৭ জন এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ২০ জন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নতুন করে ৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়ে মোট ৬ জন রোগী ভর্তি আছে এবং ১৭ জন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে বলে সিভিল সার্জন ডা. এসএম মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন।