এ পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া এবং পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু-সহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল গত ১১ জুলাই থেকে তিনদিন বাংলাদেশ সফর করে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এছাড়া নাগরিক সমাজের সদস্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং মানবিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেছেন তারা। এসব বৈঠকে উজরা জেয়া বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে একসাথে কাজ করার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, মানবাধিকার রক্ষাকর্মী, সাংবাদিক ও শ্রমিক আন্দোলন কর্মীদের নিরাপত্তার গুরুত্ব; মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা থাকা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উদ্যোগগুলোর সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরো ৭৪ মিলিয়ন ডলার অনুদানের ঘোষণা করেছেন, যার মধ্যে প্রায় ৬১ মিলিয়ন ডলার মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠী এবং অন্যদের সহায়তার জন্য দেয়া হবে। এরমধ্য দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এই অঞ্চলে রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য আমেরিকার সহায়তার পরিমাণ ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল। এছাড়াও উজরা জেয়া ফ্রিডম ফান্ড এবং এর অংশীদারদের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করেন।
এই অর্থ মানবপাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ৫০০’রও বেশি শিশুকে সমাজে পুনঃএকত্রীকরণের কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র মানবপাচারের অভিশাপ মোকাবেলায় সরকার এবং নাগরিক সমাজের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিবেদিতভাবে কাজ করছে। উজরা জেয়া বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এদিকে ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উজরা জেয়া বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনকে সমর্থন করা। তিনি বলেন, আমি যে বার্তার ওপর জোর দিতে চাই তা হলো-সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানানো। উজরা জেয়া আরো বলেন, আসুন আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দেই। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সিদ্ধান্ত ও তথ্যের ‘সতর্ক গবেষণা ও বিবেচনার’ ফল। জেয়া বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা ও জোরপূর্বক গুমের ঘটনা হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখেছি। তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, অতীত ও বর্তমানের অপকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। একইসাথে র্যাবের অর্থবহ সংস্কার করতে হবে। ‘সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে এগুলো বিবেচনা করা হবে,’ বলেও জানান মার্কিন জ্যেষ্ঠ এ কূটনীতিক। তিনি বলেন, তারা মানবাধিকার, ত্রুটি ও অপব্যবহারের উপর আলোকপাত করার জন্যও কাজ করেন; যাতে তারা অন্যের অধিকার লঙ্ঘনকারীদের সংশোধন করতে পারেন এবং জবাবদিহি করতে পারেন।
বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে সহায়তা এবং অংশীদারিত্বকে আরো গভীর করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অংশীদারিত্ব বিস্তৃত। এটা প্রভাবশালী। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জেয়া বলেন, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ এ কূটনীতিক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি খুবই স্পষ্ট করে বলতে চাই। এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের সম্ভাব্য ইজারা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
এদিকে উজরা জেয়া গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এ সময় তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মতবিরোধ নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রত্যাশা করেন। নির্বাচনের আগে বড় দুই দলের মধ্যে সংলাপের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এই মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, ‘আমরা সবাই সংলাপ চাই। তবে এই প্রক্রিয়ায় আমরা সরাসরি যুক্ত নই।’
দীর্ঘদিনের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র তার ভূমিকা রাখতে চায় উল্লেখ করে উজরা জেয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সরকারের একাধিক মন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক মানবাধিকার নীতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে উল্লেখ করেন উজরা জেয়া। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নির্বাচন এবং সুশাসনে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশীর অংশগ্রহণের ওপর বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। একটি অংশগ্রহণমূলক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতা থাকবে, যেখানে সব নাগরিকের বিকাশ হবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গতকাল বিশাল জনসভা দেখেছি। স্বস্তির বিষয়টি হচ্ছে, কোনোরকম সহিংসতা ছাড়াই সেটা হয়েছে। আমরা যেমনটা দেখতে চাই, এটা তার সূচনা। ভবিষ্যতেও এটির প্রতিফলন থাকবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।’
উজরা জেয়া জানান, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছেন। সাংবাদিকেরা যাতে অবাধে এবং কোনোরকম ভয়ভীতি এবং নিপীড়নের শিকার না হয়ে কাজ করতে পারেন, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। গণতন্ত্রে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমিকা পালন করে, সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি। তিনি বলেন, মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়ে, বিশেষ করে মতপ্রকাশের এবং সমাবেশের স্বাধীনতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
ইইউ প্রতিনিধিদলের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক আজ : সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের সাথে বৈঠক করবে আজ। গুলশানে ইইউর কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাথে দুপুর ১২টায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। জামায়াতে ইসলামীর সাথে বেলা আড়াইটা থেকে বৈঠক শুরু হবে। এতে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা: আব্দুল্লাহ মো: তাহের ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমানসহ চার সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেবেন। অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান জানিয়েছেন, তারা বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিদলকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরবেন। এছাড়া নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও তাদেরকে জানাবেন।
সংবিধান অনুযায়ী চলতি বছর ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এর জন্য ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচনের আগে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে ১৫ দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছে। গত ৯ জুলাই রোববার প্রতিনিধিদলটি ঢাকায় আসে। তাদের আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিনিধিদলটি সরকারের কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের সদস্য, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অনেকের সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে। সেখানে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেছে বলে গণমাধ্যমকে জানান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী।
জানা যায়, ইইউর প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। প্রতিনিধিদলটি মূলত আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উপযোগিতা এবং সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করবে। এ লক্ষ্যে এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশ, নির্বাচনী কাঠামোর মূল্যায়ন, ঘনিষ্ঠ অংশীদার সরকারি কর্তৃপক্ষ, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করবে।
বাংলাদেশে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ মিশন এখানে পাঠানোর উপযোগী, সুপারিশযোগ্য কিংবা সম্ভব কি না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেলের কাছে যে মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে তার ওপর ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন (ইওএম) পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠায়নি।