নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের বিরোধ নিরসনে বিদেশীদের পক্ষ থেকে সংলাপের অনুরোধ আসবে- এমন গুঞ্জন থাকলেও ঢাকা সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জায়া জানিয়েছেন, তারা সবসময়ই সংলাপের পক্ষে। তবে বাংলাদেশে এমন কোনো উদোগের সাথে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত নয়।
আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য ছয় মাসের মতো সময় বাকি থাকলেও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ নিরসনের জন্য আলাপ-আলোচনার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উভয়দলই রাস্তায় তাদের রাজনৈতিক শক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ থাক বা না থাক, বাংলাদেশে সংলাপ নিয়ে সব সময়ই আগ্রহ থাকে, আলোচনাও আছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা তৎপরতার মধ্যে উজরা জেয়ার সফরকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশে।
এই একই সময়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছে মার্কিন মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও একটি প্রতিনিধি দল।
কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দল দু’টির মধ্যে সংলাপের আর কোনো সুযোগ আছে নাকি আরো একবার রাজপথকেই সমাধান ভাবছে দলগুলো?
উদ্যোগ কে নেবে?
আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাংলাদেশের দুই বড় দল। গত ৩০ এমন অবস্থায় সংলাপের সম্ভাবনা কতটা আছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। দল দুটি’র নিজেদের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে দোষারোপ করছে অন্যপক্ষকে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, ‘সংলাপ হলেও তো পর্দার অন্তরালে কিছু হয় সব সময়ই। আগে বিহাইন্ড দ্য স্ক্রিন তো কিছু একটা হতে হবে। সেটা তো বিএনপি’কে বলতে হবে।’
তবে বিএনপি আবার বলছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই বিএনপির দাবি বিষয়ে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, ‘আমি তো সংলাপের কোনো স্কোপ দেখছি না। কোনো সংকেত তো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসছে না যে তারা ডায়লগ করতে চায়। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংলাপে সব সময়ই রাজি।’
নির্দলীয় সরকার বনাম সংবিধান
দুই দলের পক্ষ থেকে যে সংলাপের উদ্যোগ আসছে না তার মূল কারণ সংলাপ কী ইস্যুতে হবে তা নিয়ে বিপরীত অবস্থান।
সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো ধরণের নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবে না আওয়ামী লীগ। অন্যদিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপিও আগ্রহী নয় কোনো আলোচনায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানার বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরো জোরালো হয়েছে, কারণ এ বিষয়ে বিদেশী প্রতিনিধিদলগুলোরও কোনো চাপ নেই।
রাজ্জাক বলছেন, ‘বিদেশীরা এসেছে, তারা মতামত দেবে, দিচ্ছে। তবে তারা কিন্তু কখনো বলে নাই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা আলাদা কোনো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপির এই দাবি তো আসলে সংবিধানের বাইরের দাবি। এটা মানার প্রশ্নই উঠে না।’
আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু করা যাবে কিংবা নির্বাচনের পরিবেশ বা এ ধরণের কোনো বিষয় নিয়ে বিএনপি চাইলে আলোচনা হতে পারে।
অতীত অভিজ্ঞতা কী?
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সরাসরি বিরোধী তৈরি হয় মূলত: নব্বইয়ের দশকে সংসদীয় গণতন্ত্র শুরু পর। ওই সময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পরবর্তী নির্বাচন কিভাবে হবে তা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় তখনকার প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাথে।
সেই বিরোধের পরও গেল ৩০ বছরে দল দু’টির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা রকম সমস্যার তৈরি হয়েছে এবং সেসব সমস্যার সমাধান হিসেবে সবসময়ই সংলাপের কথা বলা হয়েছে। তবে দেশি-বিদেশী যে উদ্যোগেই হোক, এসব সংলাপ কোনো ফল দেয়নি।
এই ধরণের প্রথম সংলাপ হয় ১৯৯৪ সালে। কমনওয়েলথের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফানের সে উদ্যোগ অবশ্য সফল হয়নি।
এরপর ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মহাসচিব পর্যায়ের সংলাপ এবং ২০১৩ সালে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারাংকোর উদ্যোগে সংলাপও ব্যর্থ হয়। এমনকি সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের সংলাপও কাজে আসেনি। সবমিলিয়ে সংলাপে ফল কতটা আসবে তা নিয়ে সংশয় বহু পুরনো।
শামা ওবায়েদ বলেছেন, ‘আমরা তো ২০১৮ সালের আগে আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপে বসেছিলাম। এর ফল কী হয়েছে? আমরা পেয়েছি একটা নিশি রাতের ভোট ডাকাতি। সুতরাং এমন সংলাপে কোনো লাভ নেই।’
সমাধান কোথায়?
বিএনপি ইতোমধ্যেই সরকারপতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন দলটি স্পষ্টতই রাজপথে শক্তি দেখিয়ে তাদের ভাষায় দাবি আদায়ে বাধ্য করতে চায় সরকারকে। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগও বলছে রাজপথে মোকাবেলার কথা।
দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, বিএনপির পক্ষে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব না। এই শক্তি তাদের নেই। তবে যদি রাজপথে আগের মতো সহিংসতা হয়, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেটা মোকাবেলা করবে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের ত্রুটিপূর্ণ দু’টি নির্বাচনের পর এবারের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের ওপর মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ আছে। কিন্তু একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে আস্থার সম্পর্ক দরকার, সেটা এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে দুই দল থেকেই সংলাপের পরিবর্তে এখনো পর্যন্ত রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি