সরকার পতনের একদফা ঘোষণার পরের দিনই ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ ৩১ দফার যৌথ রূপরেখা ঘোষণা করল বিএনপি। সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এ রূপরেখা দিয়েছে দলটি। এতে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসার রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সম্প্রীতিমূলক রেইনবো ন্যাশন প্রতিষ্ঠা, সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং নির্বাচনকালীন দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত না করার পাশাপাশি জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে যৌথ রূপরেখায়। আছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথাও। এ ছাড়া রূপরেখা অনুযায়ী, টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।
গতকাল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ রূপরেখা ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন।
রূপরেখার ব্যাখ্যায় মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার হটানোর পর আন্দোলনরত দলগুলোর সমন্বয়ে ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি বলেন, ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, জনগণের চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিএনপিকে সত্যিকার অর্থে একটা জনকল্যাণমূলক প্রগতিশীল দল হিসেবে আমরা আমাদের কথাগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে চূড়ান্তভাবে আলোচনা করেই এসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। তবে এসব রূপরেখা একেবারে চূড়ান্ত নয়। ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসতে পারে।
‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘রাষ্ট্রের মালিকানা আজ জনগণের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্র মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে।’
৩১ দফার মধ্যে ‘সংবিধান কমিশন’, ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’, ‘মিডিয়া কমিশন’ ও ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
নির্বাচনকালীন দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনে বিদ্যমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০১১’ সংশোধন করা, আরপিও, ডিলিমিনেশন অর্ডার, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করার কথাও রূপরেখায় রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, পথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা-দায়িত্ব-কর্তব্য সমন্বয়ন করার কথাও রয়েছে এই রূপরেখায়।
আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৭, সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯, বিশেষ ক্ষমতা আইন-১০৭৪, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিলের কথাও রূপরেখায় বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ বিভিন্ন কালাকানুন বাতিল, জনস্বার্থবিরোধী কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দুর্নীতি বন্ধের কথাও বলা হয়েছে।
গত দেড় দশক ধরে সংগঠিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে শ্বেতপত্র প্রকাশ ও শ্বেতপত্রে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কার, ন্যায় পাল নিয়োগ করার কথাও বলা হয়েছে রূপরেখায়। এতে বলা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হবে। দেওয়া হবে বেকার ভাতাও।
আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ও ‘বিনা চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু নয়’ এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ‘এনএইচএস’-র আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হবে।
শিক্ষায় নৈরাজ্য দূর করতে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করাসহ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার কথাও বলা হয়েছে রূপরেখায়।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে রূপরেখায় বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে সব ইউনিয়নে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন, প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে শস্য বীমা, পশু বীমা, মৎস্য বীমা ও পোলট্রি বীমা চালু, কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন, রফতানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেওয়ার কথাও রূপরেখায় রয়েছে।
রূপরেখায় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে। স্বকীয় মর্যাদায় বহাল রেখে এই বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই রূপরেখা শহীদ জিয়াউর রহমানের ঘোষিত ১৯ দফা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষিত বিএনপির ভিশন-২০৩০ এর আলোকে এবং দেশনায়ক তারেক রহমানের ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচির সংশোধিত ও সম্প্রসারিতরূপে প্রণয়ন করা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এ রূপরেখা দিয়েছি। আমরা সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে এটা দিয়েছি। বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। আজ কিছু মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। এমনকি অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত বলছেন যে, আইএমএফের টাকা নাকি তারা নিজেরাই শোধ করতে পারেন! কী ভয়াবহ কথা!
৩১ দফা দেবে ইইউকে : আগামীকাল শনিবার ইইউর সঙ্গে বৈঠকে ‘সফল’ সমাবেশ ও রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফার বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন বিএনপি নেতারা। মূলত এই দুই বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচন সম্পর্কিত আলোচনায় বিএনপির অবস্থান ও জনসমর্থন সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
ধারণা দিল বিদেশিদের : যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি এবং মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের ঢাকায় অবস্থানকালে অনেকটা বড় সমাবেশ করল বিএনপি। দলের নেতারা বলছেন, শান্তিপূর্ণ ও অনেক লোকের সমাগমে বিএনপির সামর্থ্য ও জনসমর্থন সম্পর্কে বিদেশিরা স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন।
পুরনো কর্মসূচিতে আক্ষেপ : ঘোষণার তিন দিন পর বিদেশিদের উপস্থিতিতে ঢাকায় বড় আকারের সমাবেশ করতে পেরে বিএনপি নেতাকর্মীরা উজ্জ্বীবিত হলেও ঘুরেফিরে পুরনো কর্মসূচি দেওয়ায় কিছুটা আক্ষেপও তৈরি হয়েছে। তবে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনকে অতিদ্রুত ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে’ নিতে চায় বিএনপি। এমন চিন্তা থেকে ঢাকাকে প্রাধান্য দিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পরপর দুইদিন পদযাত্রা করবে দলটি।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, আবার পদযাত্রা কর্মসূচি দেওয়া হলেও এবার ব্যাপকতা বেশি থাকবে। কারণ সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের মেজাজ নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। ফলে আন্দোলন ভিন্নমাত্রা পাবে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শক্ত কর্মসূচি দেওয়ার অবস্থা তৈরি হবে।
সমাবেশ থেকে এক দফার ঘোষণা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছিল। ফলে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী অনেক কর্মীকে সমাবেশে দেখা গেছে। দলের নেতারা মনে করেন, তরুণরাও যে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ, তারা সে বার্তাও পেয়েছেন।
শক্ত কর্মসূচি প্রত্যাশা করেছিল নেতারা : বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সমাবেশ থেকে প্রথমে বিক্ষোভ কিংবা গণঅনশন কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু এক দফার কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে এ ধরনের সাদামাটা কর্মসূচি নেতিবাচক বার্তা দিত- এমন চিন্তা থেকে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তবে এতেও নেতাকর্মীরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা ঘেরাওয়ের মতো শক্ত কর্মসূচি প্রত্যাশা করেছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, বিদেশিদের চোখে সহিংস কর্মসূচি নেতিবাচক ধারণা দেয়। হরতাল-অবরোধ দিলে সহিংসতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতিপক্ষ এ ধরনের কর্মসূচিতে নেতিবাচক প্রেক্ষাপট তৈরির সুযোগ পায়। তা ছাড়া এ ধরনের কর্মসূচি মার্কিন নতুন ভিসানীতির আওতায় পড়তে হতে পারে। ফলে এ ধরনের কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হওয়ার মতো প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হবে।