নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে থাকা শ্রীলংকার দুর্দশা কাটেনি। গত বছরের ৯ জুলাই বিক্ষুব্ধ জনতার রোষের মুখে দেশটির প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসা ক্ষমতাচ্যূত হন। তবে এক বছর পরেও দেশটি এখন দারিদ্রে ধুঁকছে। খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির বিশাল সংখ্যক মানুষ। খবর বিবিসির।
দেশটির তেমনি একজন কারুপ্পাইয়া কুমার। তিন সন্তানের জনক কারুপ্পাইয়া কুমার পেশায় দিন মজুর। তিনি বলেন, কাঁঠাল খেয়ে আমরা লাখ লাখ মানুষ প্রাণে বেঁচে আছি। অনাহারের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে এই কাঁঠাল।
দেশটিতে একসময় একসময় ফল হিসেবে সবচেয়ে অবজ্ঞা করা হতো কাঁঠালকে। এই ফলই এখন শ্রীলংকানদের প্রাণ রক্ষাকারী আহার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে ১৫ কেজি কাঁঠাল পাওয়া যায় প্রায় এক ডলার সমমূল্যে।
৪০ বছর বয়সী কারুপ্পাইয়া আরও বলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কটের আগে প্রতিটি মানুষের ভাত বা পাউরুটি কেনার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন খাবারের দাম এতটাই নাগালের বাইরে চলে গেছে যে বহু মানুষ প্রায় প্রতিদিন কাঁঠাল খেয়ে আছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে। এখন প্রতি দুইটি পরিবারের মধ্যে একটিকে বাধ্য হয়ে তাদের আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে খাবারদাবারের ওপর।
কারুপ্পাইয়া কুমার, স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে থাকেন এই বাড়িতে
দেশটির আরেক বাসিন্দা তিন সন্তানের মা নাদিকা পেরেরা বলেন, আগে আমরা তিন বেলা খেতাম। এখন খাচ্ছি দুবেলা। ১২ কেজি ওজনের রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম গত বছর পর্যন্ত ছিল ৫ ডলার। সিলিন্ডারের দাম এখন দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। ফলে এখন বাধ্য হয়ে পুরনো পদ্ধতিতে চুলা জ্বালিয়ে রাঁধতে হচ্ছে।
২০২২ সালে শ্রীলংকা তার ইতিহাসে নজিরবিহীন সবচেয়ে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়। দেশটির অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় এর পর থেকে মানুষের আয় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে।
সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশটিতে বিরামহীন বিদ্যুতের অভাব আর জ্বালানির মজুত ফুরিয়ে আসার পটভূমিতে যে তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয়েছিল তার জেরে জনগণ প্রেসিডেন্ট গোটাাবায়া রাজাপাকসার সরকারি বাসভবনে চড়াও হয় গত বছর ৯ জুলাই। এরপর দেশ ছেড়ে পালান রাজাপাকসা।
এরপর দেশটির সরকার দেনদরবার করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে ঋণ জোগাড় করতে সমর্থ হলেও দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে দারিদ্র দ্বিগুণ বেড়েছে।
স্বামী ও সন্তান নিয়ে নাদিকা থাকেন রাজধানী কলম্বোর ছোট একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে। সেখানে শোবার ঘর মাত্র দুইটি।
নাদিকা
নাদিকা জাতীয় ক্যারাম চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী সাবেক প্রতিযোগী। কিন্তু তিনি অর্থের অভাবে রয়েছেন। ক্যারাম এশিয়ার জনপ্রিয় একটি খেলা। কিন্তু ক্যারাম খেলায় রেফারি হয়ে তিনি যে অর্থ উর্পাজন করতেন তা এখন বন্ধ। তার স্বামী এখন জীবিকার তাগিদে ভাড়ার ট্যাক্সি চালান।
তবে গত জুন মাসে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ১২%এ নেমেছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তা ছিল ৫৪%। তারপরেও পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশটির প্রায় ৮৫% ওষুধ বাইরে থেকে আমদানি করে। দেশটিতে অর্থনৈতিক সঙ্কট যখন শুরু হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ে ঘাটতি হয়, তখন থেকে শ্রীলংকায় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্রের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে।
শৈল শহর ক্যান্ডির শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোয়া ডি জয়সা এমন পরিস্থিতির একজন প্রত্যক্ষ শিকার। তার ফুসফুসের ফাইব্রোসিসের চিকিৎসার জন্য ভারত থেকে ওষুধ আনতে তাকে রীতিমত বেগ পেতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত নয় মাস আগে তিনি মারা যান।
তার স্ত্রী মালিনী ডি জয়সা বলেন, ওষুধ আনাতে অনবরত যে ধরনের বিলম্বের শিকার তাকে হতে হচ্ছিল তা নিয়ে রীতিমত হতাশ ছিলেন তিনি, কিন্তু তার বই লেখার কাজ তিনি থামাননি। তিনি জানতেন তার মৃত্যু আসন্ন কারণ ওষুধ ছাড়া এই রোগ থেকে সেরে ওঠা সহজ নয়।
শ্রীলংকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেহেলিয়া রাম্বুওয়েলা ইতিমধ্যেই মানুষজনকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে চড়া দাম এবং ঘাটতি থেকে অবিলম্বে পুরো পরিত্রাণের সম্ভাবনা নেই।