বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মেরুকরণ এখন স্পষ্ট। দেশের রাজনীতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে পরাশক্তিধর দেশগুলোর বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য-বিবৃতির লড়াইও দৃশ্যমান হচ্ছে ক্রমে। এমন প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত এবং তা নিজেদেরই করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী রাজনীতির গতিধারা এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ মাসেই রাজনীতির গন্তব্য স্পষ্ট হতে পারে বলেও মনে করছেন তারা। বিএনপিসহ বিরোধীপক্ষ এ মাসেই এক দফার আন্দোলন ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এই ঘোষণার পর রাজনীতির মাঠ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। এ সময় সরকার ও বিরোধীপক্ষ অনড় অবস্থানে থাকবে নাকি ছাড় দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে হাঁটবে- সেটাও এখন দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল বা বাধা প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হবে। এ ছাড়া গত মে মাসে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন ছয় কংগ্রেস সদস্য। একই ইস্যুতে গত জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেলকে চিঠি পাঠান ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য।
পশ্চিমা দেশগুলোর এসব তৎপরতাকে নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে দেখছে রাশিয়া। তারা বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচন কীভাবে হবে, সেটা দেশটির আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোতে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন। গত শুক্রবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মুখপাত্রের পুরো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন বাংলাদেশে অবস্থানের সময়েই এমন অবস্থান জানিয়েছে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আগামী ১১ জুলাই চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। প্রতিনিধি দলে দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর নামও রয়েছে। উজরা জেয়ার সফরে আগামী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে সে কথা স্বীকার করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের চিঠির সমালোচনা করে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বৃহস্পতিবার বলেন, এটা নব্য উপনিবেশবাদ ছাড়া আর কী? এটা নগর এবং পাড়া-মহল্লার প্রতি তাদের আচরণের প্রদর্শন ছাড়া আর কী? এগুলো একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের চেষ্টা। রাশিয়ার এমন বক্তব্যের ব্যাপারে কিছু বলতে নারাজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুুল মোমেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘এটা তাদের বক্তব্য। আমার বলার কিছু নেই।’
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে পরাশক্তিগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান জানান দেয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত বৃহস্পতিবার রুশ বক্তব্যের মাসখানেক আগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সমালোচনা করে চীন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশের বিশেষায়িত নিরাপত্তা বাহিনী র?্যাব এবং এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন করে চীন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় চীন সব সময় সমর্থন দেবে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র?্যাব এবং সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এর আগেও রাশিয়ার মার্কিনবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে এসেছে। গত বছর রাজধানীর শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল নিয়ে আসা মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজ ‘উরসা মেজর’ বাংলাদেশি বন্দরে নোঙর করতে না পারার জেরে নজিরবিহীন বিবৃতি দেয় রুশ দূতাবাস। এতে বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙে হস্তক্ষেপ করছে। তার প্রত্ত্যুত্তরে পশ্চিমা দূতাবাসগুলো রাশিয়ার হস্তক্ষেপ না করার ধারণা ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কিনা এমন প্রশ্ন তোলে। এমন জবাবের পর রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বিগুণ অসন্তোষ প্রকাশ করে।
গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভৌগোলিক কারণে অনেকের নজর আমাদের দিকে। এত দ্রুত উন্নয়নের কারণে আমরা অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেছি। এই যে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, গুম- এগুলা সব ভাঁওতাবাজি। বিভিন্ন দেশেই মানুষ হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। তারা (পশ্চিমারা) বলে আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। অথচ আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না।’
তবে বিশে^র বড় শক্তিগুলোর এসব মেরুকরণকে স্বাভাবিক বলেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘একমাত্রিক বিশ্ব আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে। সুতারং একক কোনো দেশের খবরদারি কমে যাবে স্বাভাবিকভাবেই। বিদেশিরা বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলে, কারণ আমাদের বিরোধী দলগুলো ও সুশীল সমাজ সে সুযোগ করে দেয়।’ এসব তৎপরতায় বাংলাদেশে বিভাজন বাড়বে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘বিদেশিরা এসে কখনো সমাধান করবে না বা করার কথাও নয়। বরং তারা এই বিভাজনটাকে বাড়িয়ে তাদের যতটুকু সুবিধা নেওয়ার, সেটা নিচ্ছে অথবা না জেনেশুনে তারা এমনটা করছে। আমাদের নির্বাচনব্যবস্থায় ত্রুটি আছে। সেটা আমাদের ঠিক করতে হবে।’
আরেক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবীর মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনকে ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা অমূলক এবং অপ্রয়োজনীয়। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে সমস্যা রয়েছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, তার শান্তিপূর্ণ সমাধান অভ্যন্তরীণভাবেই হওয়া উচিত।