আমের রাজধানী রাজশাহী না চাঁপাইনবাবগঞ্জ- এ নিয়ে আমপ্রেমীদের মাঝে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। তবে সেই বিতর্ক চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর মধ্যে আরও উসকে দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। কিছু দিন আগে এক ভিডিওতে নওগাঁকে ‘আমের রাজধানী’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তবে ফেসবুকে এই ভিডিও দেখে একরকম ফুঁসে ওঠেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার সুমন আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করে বলেন, ‘আসলে অনেক আগে থেকে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। নওগাঁয় এত আমবাগান দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে কথাটি বলে ফেলেছিলেন। তবে অবাক করা তথ্য হলেও সত্য- এখন আর আমের সেই রাজত্ব থাকছে না চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা রাজশাহীর। কারণ হালে উৎপাদনের দিক দিয়ে শুধু রাজশাহীকেই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে নওগাঁ। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়েও নওগাঁয় আমবাগান কম। তবে রাজশাহীর চেয়ে এখন বাগান বেশি নওগাঁতেই।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, ২০১৫-১৬ মৌসুমে রাজশাহী জেলায় আমবাগান ছিল ১৬ হাজার ৯৬১ হেক্টর জমিতে। এ মৌসুমে নওগাঁয় আমবাগান ছিল ১২ হাজার ৬৭০ হেক্টর। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছিল ২৪ হাজার ৪৭০ হেক্টর। এ মৌসুমে রাজশাহীতে এক লাখ ৮১ হাজার ১০৭ টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ লাখ ৪০ হাজার টন এবং নওগাঁয় এক লাখ ৫৮ হাজার ৬১৫ টন আম উৎপাদন হয়। এর পরের বছর থেকেই নওগাঁ আম উৎপাদনে এগিয়ে যায়। বাগানও বেড়ে যায় রাজশাহীর তুলনায়।
কৃষি বিভাগের হিসাবে, সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ১৬৫ হেক্টর এবং রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে বাগান ছিল। এ বছর নওগাঁয় বাগান ছিল ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে। রাজশাহীতে ২ লাখ ৬ হাজার ১৫৬ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৬ টন আম উৎপাদন হয়। তবে এ দুই জেলাকে ছাড়িয়ে নওগাঁয় উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার টন আম।
নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার, মান্দা ও পোরশা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ছোট ছোট গাছের আমবাগান। নিয়ামতপুর উপজেলার চৌরাকসবা গ্রামের চাষি জুলফিকার আলী জানান, তার তিন বিঘা জমিতে বাগান। এর মধ্যে দুই বিঘার বাগান আম্রপালি গাছের। অন্য এক বিঘা বাগান কাটিমন আমের। আগে এসব জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসলের চাষ হতো। কিন্তু চাষাবাদের জন্য ঠিকমতো সেচের পানি পাওয়া যেত না। তাই অন্য ফসল বাদ দিয়ে করেছেন বাগান। গত কয়েক বছরে জুলফিকারের মতো শত শত চাষি অন্য ফসল বাদ দিয়ে এখন জমিতে বাগান করেছেন।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ জানান, শুধু সেচ সংকটের কারণে নওগাঁয় অন্য ফসল ছেড়ে বাগানের দিতে ঝুঁকেছেন চাষিরা। নওগাঁয় এখন রাজশাহীর চেয়ে বেশি জমিতে বাগান আছে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে কম। তার পরও উৎপাদনে দুই জেলাকেই পেছনে ফেলেছে নওগাঁ। এর কারণ নওগাঁয় পরিকল্পিতভাবে উন্নতজাতের গাছের বাগান করা হয়েছে। সব বাগানেই এখন কলম করা ছোট ছোট গাছ। অল্প জমিতে গাছ আছে বেশি। গাছ ছোট বলে পরিচর্যা করাও সহজ। ফলে নওগাঁয় উৎপাদন হচ্ছে বেশি। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশির ভাগ বাগানেই বিশাল বিশাল আকারের ফজলি আমের গাছ। একেকটি গাছ অনেক জায়গা দখল করে আছে। রাজশাহীতে ছোট-বড় দুই ধরনেরই গাছ রয়েছে। যে বাগানের গাছ ছোট, সেই বাগানেই উৎপাদন বেশি। তা ছাড়া রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরনো গাছে উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে নওগাঁয় নতুন নতুন গাছে উৎপাদন বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নওগাঁয় আমের ফলন সব সময়ই বেশি। সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে রাজশাহীতে ১১ দশমিক ১৩ টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১০ দশমিক ৬৭ টন এবং নওগাঁয় ১২ দশমিক ৫৫ টন আম উৎপাদন হয় হেক্টরপ্রতি।
দেশের সবচেয়ে বড় আমেরহাট বসে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। এর পর দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের হাট রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ^রে। তবে নওগাঁর সাপাহার উপজেলা সদরের হাটও ছোট না। সাপাহারের জিরোপয়েন্ট থেকে গোডাউনপাড়া পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এবং এর আশপাশে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাট বসছে আমের। এই তিন হাটেই তিন জেলার বেশিরভাগ আম বিক্রি হয়। এসব হাট থেকে আম চলে যায় দেশের নানাপ্রান্তে। সম্প্রতি এই তিন হাটের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, দাম সবচেয়ে বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জে, আর সবচেয়ে কম রাজশাহীতে। এ দুই জেলার মাঝামাঝি দাম নওগাঁয়।
উন্নতজাতের খিরসাপাত ও হিমসাগর আম শেষের দিকে। সাপাহারে এখন আম্রপালি আমের দাম মণপ্রতি দুই হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ল্যাংড়া ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০, হিমসাগর ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৪০০, নাকফজলি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৪০০, কাটিমন ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০, ব্যানানা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ এবং হাঁড়িভাঙা ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কানসাটে খিরসাপাত বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০, ল্যাংড়া ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার এবং ফজলিসহ নানা জাতের গুটি আম বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে তিন হাজার টাকা মণ দরে। বানেশ^রে এ দিন লক্ষণভোগ ৭০০ থেকে ৮৫০, ফজলি ৬০০ থেকে ৯০০, ল্যাংড়া ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৪০০, আম্রপালি ১ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৪০০, কালুয়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ এবং গুটি আম প্রতিমণ ১ হাজর ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাষি কিংবা বাগান ইজারাদাররা এই দামে আম বিক্রি করছেন। আড়ৎদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব আম কিনছেন। মৌসুমের শেষের দিকে বাজারে আসবে বারি-৪, গৌড়মতি ও আশি^না জাতের আম।
আমের দাম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে রাজশাহীর পুঠিয়ার গ-গোহালী গ্রামের আমচাষি পিয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এত কষ্ট করে আম করে মণে ২ হাজার টাকাও পাচ্ছি না। এই আমই আড়ৎ, পাইকারি ব্যবসায়ী এবং খুচরা ব্যবসায়ী হয়ে সাধারণ ক্রেতার কাছে যাবে ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে। সব লাভ ব্যবসায়ীরাই খেয়ে ফেলছেন। চাষির তেমন কিছু থাকছে না।’
দাম নিয়ে খুশি নন রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোজদার হোসেনও। তিনি বলেন, ‘এবার ঝড়ে আম পড়েনি বলে উৎপাদন খুব বেশি। কিন্তু দাম কম। নানা জাতের আমের গড় দাম ৪০ টাকা কেজি। এই দামে আম বিক্রি করে তো বাগানিরা খুব বেশি লাভ করতে পারবে না।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা পলাশ সরকার অবশ্য দাম নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে ৭০ ভাগ গাছ হলো ফজলির। এখনো ফজলি সেভাবে ওঠেনি। এখন যা আছে তার দাম ভালো। মানসম্মত আম উৎপাদন হয়েছে বলে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।’
নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদও দাম নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রচুর আম্রপালি আম। এই আমের চাহিদা বেশ ভালো। তাই দামও ভালো।’ তিনি বলেন, ‘নওগাঁয় সব নতুন বাগান। ছোট ছোট গাছ। এগুলো পরিচর্যা সহজ, তাই ফলনও ভালো।’
কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তারা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হওয়ার আশা করা হচ্ছে। রাজশাহীতে আশা করা হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। আর নওগাঁয় আমের বাণিজ্য হতে পারে দুই হাজার কোটি টাকার।