কারাগারে মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু

Slider জাতীয়


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এসে পৌঁছেছে। জেলকোড অনুযায়ী, চিঠি হাতে পাওয়ার ২১ দিন থেকে ২৮ দিনের দিনের মধ্যে যে কোনো দিন ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি গত বুধবার রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছেছে। তবে ফাঁসি কার্যকরের আগে নানা প্রক্রিয়া রয়েছে। জেলকোড মেনে এখন সে প্রক্রিয়াগুলোই শুরু করতে চায় কারা কর্তৃপক্ষ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকেই কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারাগারের একজন কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রায় ছয় মাস আগে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। গেল জুনে শেষ সপ্তাহের দিকে রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। এর মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও নিহত অধ্যাপক তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে চলমান সব দাপ্তরিক ও আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়। প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি রাজশাহী কারাগারে পৌঁছার কথা তখন স্বীকার করেনি কারা কর্তৃপক্ষ। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তা স্বীকার করেছেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নিজাম উদ্দিন। তিনি জানান, গত বুধবার ডাকযোগে চিঠি এসে পৌঁছেছে।

রাজশাহীর ডিআইজি (প্রিজন) কামাল হোসেন বলেন, প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতি নাকচ করার ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরে সব বাধা শেষ হয়েছে। তবে ফাঁসি কার্যকরের আগে আগে জেলকোড অনুযায়ী কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে আদেশ প্রাপ্তির ২১ দিন হতে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জেলকোডের ৯৯৯ বিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিনক্ষণ ঠিক করার পর আত্মীয়স্বজনকে শেষ দেখা করার জন্য খবর দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, জেলকোডের ১০০১ বিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড রাতের যে কোনো সময় কার্যকর করা হয়। জেলকোডের ১০৩ বিধি অনুযায়ী এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার উপস্থিত থাকেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আইনি কোনো বাধা না থাকলেও এ সংক্রান্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা প্রয়োজন। যেহেতু আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে, কাজেই এখন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষই ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেবে। এখন আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া তারা শুরু করবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ

কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাবির ভুতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম নিম্ন আদালতে মামলার রায় ঘোষণার পর থেকেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারেই আছেন। তাদের দুজনকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল ছুটিতে আছেন। তবে জেলখানার দায়িত্বে আছেন জেলা প্রশাসনের এ ডি এম সাবিহা সুলতানা। তিনি জানান, প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি হাতে পাওয়ার পর আর আইনি কোনো বাধা নেই। কাজেই এখন জেলকোড অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরে উদ্যোগ নেবে কারা কর্তৃপক্ষ।

নিহত অধ্যাপক তাহেরের মেয়ে ও এই মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সেগুফতা আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি নৃশংস ঘটনা। আমার বাবাকে হত্যার পর খুনিরা ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রেখেছিল। কী বীভৎস দৃশ্য! আমি আমার বাবার লাশটাও সেদিন দেখতে পারিনি। বাবার হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিতে আমি নিজেই আইনি লড়াইয়ে ছিলাম। এখন আর আইনি কোনো বাধা নেই। কারা কর্তৃপক্ষ যে কোনো দিন রায় কার্যকর করতে পারে। আমরা রায় বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় আছি।’
রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে ড. তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ ও মেয়ে শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ

এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও অধ্যাপক মিয়া মহিউদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক মহিউদ্দিনের স্ত্রীর ভাই ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক নির্ঝর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পশ্চিমপাড়া আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক তাহের আহমেদ। বাসাটিতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বাসাটির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক এস তাহের আহমেদের গলিত মরদেহ। ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

এদিকে পুলিশ অধ্যাপক তাহেরের করা একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেন পুলিশ। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধাপক তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। মূলত পদোন্নতি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মিয়া মহিউদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।

তিন আসামি জবানবন্দিতে আরও বলেন, বালিশচাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ বাসার পেছনে নেওয়া হয়। মরদেহ গুমের জন্য জাহাঙ্গীর আলম তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামকে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ডাঁশমারী গ্রাম থেকে ডেকে আনেন। তাদের সহায়তায় বাসার পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ ঢাকনা খুলে ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়।

২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন পুলিশ। এ হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন। দণ্ডিতরা হলেন- বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালাম। তবে বিচারে খালাস পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সি।

পরবর্তীতে দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের রায় বহাল রাখলেও আসামি নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রী ভাই আব্দুস সালামের রায় কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। তবে আপিলে সাজা কমে যাবজ্জীবন হওয়া দুই আসামির দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *