আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় খুব বেশি নেই। ইতোমধ্যে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আগ্রহের কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছে এ নির্বাচন। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিতে সরব যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কূটনীতিকরা। বিভিন্ন ফোরামে তারা এ প্রসঙ্গে কথা বলছেন, নিজেদের মতামত তুলে ধরছেন।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক তথা গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের দেশের আগ্রহের কথা তারা জানাচ্ছেন। প্রতিটি বৈঠকেই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বোঝার চেষ্টা করছেন, আগামী নির্বাচন কেমন হতে পারে, কোন দলের কৌশল কী হবে, ন্যূনতম কেমন পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে যেতে পারে। কূটনীতিকরা এখন নিজেদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সমীকরণ মেলানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদিকে মাঠ এবং কূটনীতির টেবিলে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে জুলাই মাস। সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ মাসেই দলটি একদফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে। যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় অন্য দলগুলোও একদফা আন্দোলনে নামছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামার চেষ্টা করছে জামায়াতও। অন্যদিকে বিএনপির কর্মসূচির বিপরীতে গত কয়েক মাস ধরে পুরোদমে শান্তি সমাবেশ করে আসছে আওয়ামী লীগ। সামনে সরকার ও বিরোধীপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি এ ধরনের কর্মসূচি আরও জোরদার হবে বলে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে, আগামী নির্বাবচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে আগামীকাল গুরুত্বপূর্ণ সফরে ঢাকা আসছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন। এ ছাড়া আগামী ১১ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ সফরে বাংলাদেশে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নাগরিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। ওই প্রতিনিধিদলের তালিকায় দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর নামও রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরেই তাদের এই সফর।
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, সে সম্পর্কে ধারণাা পাওয়া যেতে পারে। কারণ, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অবস্থান এখনই স্পষ্ট করার সময় এসেছে।
আগামীকাল শনিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া সফরে ইইউর উচ্চপর্যায়ের ‘স্বাধীন পর্যালোচনা মিশন’ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ ইইউ পর্যবেক্ষক দল পাঠানো ‘কার্যকর’ হবে কিনা সেটি খতিয়ে দেখবে। দলটি দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান করে সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলবে। এর মাধ্যমে তারা দেশের রাজনৈতিক গতিধারা কোন দিকে যাচ্ছে তার ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করবে। সফরে আসা দলটির তৈরি প্রতিবেদন ইইউর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেফ বোরেলের কাছে যাবে। তিনি বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেশে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেবেন। অবশ্য জোসেফ বোরেল ইতোমধ্যে বলেছেন, পর্যবেক্ষক মিশন তখনই মোতায়েন করা হবে, যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য কোন কোন বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হবে, তা পর্যালোচনা মিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসবে বলে জানা গেছে।
ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের সফর নিয়ে বলেছেন, আমরা এখানে রাজনীতিতে মধ্যস্থতা কিংবা হস্তক্ষেপের জন্য নই; শোনা ও বোঝার জন্য আমরা এখানে। আমরা সব দলের সঙ্গেই বসব। আমরা এখানে কোনো সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা দেখতে চাই না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের মানুষও এটাই চায়।
হোয়াইটলি আরও বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য কোন কোন বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হবে, তা পর্যালোচনা মিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসবে। এ কারণে আমরা এখন বলতে পারি না, অমুক দল যোগ দিলে বা না দিলে অংশ্রগহণমূলক নির্বাচন হবে কিনা। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয় দেখবেন এবং তাদের রাজনৈতিক অভিমত দেবেন। পরে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা তার সিদ্ধান্ত নেবেন।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এমন পটভূমিতে আগামী ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকায় আসছেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরের সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুদফায় বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বেলা ১১টার দিকে যান পিটার হাস। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সঙ্গে। এর আগে গত বুধবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতের বাসায় পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে চা-চক্রে যোগ দেন। সকালে ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির বাসভবনে এ বৈঠকে ১২টি দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও কূটনীতিক যোগ দেন।
সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে ইইউর প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটির ঢাকা সফরের কার্যক্রম ও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে চা-চক্রে আলোচনা হয়। এতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত, কানাডার হাইকমিশনার, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার, স্পেনের রাষ্ট্রদূত, জার্মানির উপরাষ্ট্রদূত, জাপানের উপরাষ্ট্রদূত, সুইডেন দূতাবাসের কাউন্সিলর, ইতালির উপরাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাইকমিশনের কর্মকর্তা ও নেদারল্যান্ডসের উপরাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও ইইউর প্রতিনিধি দলের সফর নির্বাচনকেন্দ্রিক কিনা এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল নির্বাচনের জন্য আসছেন এটা আমাদের জানার মধ্যে নেই। এখানে অনেক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, তার মধ্যে একটা হয়তো থাকবে নির্বাচন নিয়ে, সেটাকে রুল আউট করছি না। এটা যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সফর, সেটা ঠিক নয়। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওইটাও (প্রতিনিধি দল) অনেক দিন ধরে কথাবার্তা হচ্ছে। তাদের মিশনটা মোর ইলেকশন স্পেসিফিক, এইটা সত্যি। এখানে তারা ঠিক করবেন, ইলেকশনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা।