এতদিন ডেঙ্গু মশার প্রজনন ও বিস্তার মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও এবার রাজধানীর বাইরেও মারাত্মক আকার নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের জেলা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বিভাগ এবং নদীবেষ্টিত বরিশাল অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। আর এতে করে ডেঙ্গুতে এবার বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর আগে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে প্রাথমিক সংক্রমণ ঘটলেও মশা নিধনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে, দ্রুত সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে। দু-চার দিনের মধ্যে বাকি জেলাগুলোতেও ছড়াবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনার বছর ২০২২ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত ২৩ জেলায় ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। সেখানে একই সময়ে চলতি বছর ৫৬ জেলায় ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। এমনকি এক মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮টি জেলায়। সেখানে ত্রিশ দিনের ব্যবধানে আক্রান্ত জেলার সংখ্যা বেড়েছে ১৮টি।
ঢাকা ছাড়াও শতাধিক রোগী মিলেছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জসহ আট জেলায়। ২০১৯ সালে রাজধানীর বাইরে যেসব জেলায় সংক্রমণ ঘটেছিল, এসব জেলা ছিল তার শীর্ষে।
গত পাঁচ বছরে যেসব জেলায় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বরিশাল তার অন্যতম। শুধু এ জেলা নয়, পুরো বিভাগেই বিশেষ করে পটুয়াখালী ও বরগুনায় ক্রমশ ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ বিভাগে ৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু বরিশাল জেলাতেই এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, রোগীদের বড় অংশই ঈদে বাড়ি ফেরত রাজধানীর লোকজন। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ ম-ল জানিয়েছেন, ‘ঈদের সময় প্রচুর মানুষ বাড়িতে এসেছে। একটু অসুস্থ হলেই মানুষ ঢাকা থেকে বরিশালে বাড়ি ফিরছে।’
এদিকে, চাঁদপুরে চলতি বছর এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক ডেঙ্গু রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জেলার সিভিল সার্জন মো. শাহাদাত হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেভাবে রোগী বাড়ছে এটি আমাদের জন্য অ্যালার্মিং। সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ঈদে বাড়িতে আসায় তাদের মাধ্যেমেও সংক্রমণের বিস্তার ঘটতে পারে। তবে স্থানীয় সরকারের মশা নিধনে আরও কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার।’
চট্টগ্রাম নগরীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বলে সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম
চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছেন সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। চিঠিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মশক নিধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। জেলা সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী আমাদের সময়কে জানান, ‘আগেও করপোরেশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি জানানো হয়েছে। এবার আবারও তা অবহিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৪২ ডেঙ্গু রোগী।’
অন্যদিকে শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন করে ৮০ শয্যার দুটি ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এমনিতেই কার্যক্রমে দুর্বলতা প্রকট। সেখানে ঢাকার বাইরের সিটি করপোরেশেন, পৌরসভা এবং স্থানীয় সরকারের এডিস মশা নির্মূলে তেমন কার্যক্রম নেই। ফলে সংক্রমণ ঘটলেও রোগী ব্যবস্থাপনায় কেবল গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, প্রতিকারের তেমন জোরদার ব্যবস্থা মিলছে না। যা দেশের সর্বত্র ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ।
জাহাঙ্গীনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেসব জেলায় ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটির পেছনে স্থানীয় সরকার দায়ী। চলতি বছরের শুরু থেকেই আমরা বলে এসেছি এবার ডেঙ্গু সব জেলাতেই ছড়াবে। তারপরও আমরা সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে দেখিনি।’
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ এখন জেলা শহরেও। যেখানে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই ভবন হচ্ছে, প্লাস্টিকের ড্রাম, ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ জেলাতেই এখন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় প্রাথমিক পরীক্ষা সহজে করতে পারলেও গ্রামাঞ্চলে হচ্ছে না। ফলে সেখানেও রোগী বাড়ছে কিন্তু শনাক্তের হার কম। গতানুগতিক কাজ নিয়ে ডেঙ্গুর এমন বেসামাল অবস্থা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এটাকে আরও জোরদার করতে লোকবল বাড়াতে হবে, হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক লাগবে।’
আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ কয়েকগুণ বেশি। এর পেছনে তিনটি কারণ দেখছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে ডেঙ্গুর প্রাক-মৌসুম জরিপ ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার মৃত্যু বেশি হওয়ার পেছনে রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে আসার পাশাপাশি একাধিকবার এবং একাধিক ধরনে আক্রান্ত হওয়া।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৬৬১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যার প্রায় অর্ধেকই ঢাকার বাইরে। এতে করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১১ হাজার ১১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে মারা গেছেন ২ জন। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬৪ জনে ঠেকেছে।